ফাইল ছবি
হঠাৎ পুকুরের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে, ফড়াম শব্দে একটি মাছ লাফ দিয়ে হালকা উপরে উঠে দেখা দিয়েই আবার পানিতে হারিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, এলাঙ্গীর বিলের কথা। পলোর মধ্যে মাছ এসে ফড়ফড় করে বেরিয়ে গেলে, সারাদিন সেই শোকে কুঁকড়িয়ে থাকতাম।
আমি আর পিকলু উপজেলার মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম। তখন রাত আটটা কি নয়টা বাজে। পুকুরের ধারে নারিকেল গাছ, এ হেমন্তেও গাছের পাতাগুলো দুলছে, মৃদু মৃদু সুরেলা ছন্দে, শব্দ করে দুলে উঠছে অন্ধকার আকাশে।
আমরা প্রতিরাতেই এই পথে হাঁটি। উপজেলার ভিতরে প্রায় দুই কিলোমিটার গোল হাটা পথ রয়েছে। যেখান থেকে হাঁটা শুরু করি সেখানেই ফিরে আসি। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, কি হবে নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে? সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরী বিষয়গুলো তো এমপিরা মতামত দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, লিখে নিলেই হল আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকা যাবে?
পিকলু হোঁহোঁ-হেঁহেঁ করে হেসে বলল, বাদ দেন রাজনীতির কথা। একটা মজার প্রেমের গল্প শোনেন।
এমন সময় রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে তেঁতুল গাছ থেকে সড়সড় শব্দে একটি সাদা বুনো পাখি উড়ে গেল। হয়তো নিজ বাসায় ফিরতে গিয়ে রাত হয়ে গেছে, তাই এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের হাঁটার শব্দে পালানোর চেষ্টা করে,অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে চলে গেল।
আবার পিকলু বলা শুরু করল, আমাদের বাড়িতে আশির দশকে বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। সেই অপরুপ সুন্দরী মেয়েটি গোয়াল পরিষ্কার করা, উঠান ঝাড়ু দেওয়া, থালাবাসন মাজা ইত্যাদি কাজ করত। আর মোহাম্মদ আলী নামে এক জন হ্যান্ডসাম রাখাল ছিল ।সে গরু-মোষকে খেতে দেওয়া, ভোরে উঠে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে জমি চষতে যাওয়া ও মাঠের ফসলাদি ঘরে আনা, এ ধরণের কাজ করত।
বলতে বলতে পিকলু হোঁহোঁ করে আবার একাই হাসল। গল্পের মধ্যে আমরা হাঁটছি আর হাঁটছি।
ওর জোরে শব্দ করে হাসির মধ্যে আমিও দু'একবার হেসে উঠছি।
আবার বলা শুরু করল, জানেন সেই সুন্দরী জামেলা আর মোহাম্মদ আলী এক সময় প্রেম করে ফেলে। গোপন অভিসার চলতে থাকে। এদিক-ওদিক ঢুঁ মেরে বেড়ায়। তাই একদিন আমার আব্বা আর আম্মা পারিবারিক ভাবে ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য জামেলাকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। ওদের তেমন টাকা-পয়সা নেই। আব্বা নিজেই টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়ের আলোচনা করতে লাগল।
তো,দিন-সময় ঠিক করে, ওদের বাড়ি, আমরা দেখতে গেলাম জমেলাকে। জাস্ট আনুষ্ঠানিকতা ।
দেখতে গিয়ে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে জামেলার বাপের কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবী করা হল। জামেলার বাপ তিন হাজার টাকা দিতে রাজি হল। বাড়ি ফিরে আসার সাথে সাথে মোহাম্মদ আলী খুব আগ্রহ ভরে এসে আমাকে বলতে লাগল,কি হইলু মাইজ ভাই?
আমি আবার আমার বাবা-মার মেজো ছেলে। তাই সবাই মাইজ ভাই বলে ডাকে। আরও একবার হেসে পিকলু বলতে লাগল, দেখেন তো,হুইপকে সবাই মেজো ভাই বলে ডাকে। ওরা যদি আমাকে মেজো ভাই বলে ডাকে, তাও তো মনে সান্ত্বনা জাগে-নিজেকে হুইপ হুইপ লাগে। পিকলুর কথা শুনে হেসে পড়লাম।
আবার বলতে লাগল, তা-না,শালারা খালি মাইজ ভাই,মাইজ ভাই করে।
আমি প্রশ্ন করলাম,আপনি হুইপ হয়ে কি করবেন?
পিকলু বেশ গর্ব করে বলল, বড়লোক হতাম।-জেলার সব নিয়োগ, মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত, গমচাল বিক্রি করে,মেরে-কেটে খেয়ে,কোটি কোটি টাকার মালিক হতাম।
আমি বললাম, ওরা মেজো ভাই বলে ডাকলেই তো আপনী হুইপ হয়ে যাবেন না?
-আরে ভাই কল্পনা করতে তো দোষ নেই।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে দিলাম,বললাম, আচ্ছা সেই জামেলা সুন্দরীর কি হল?
কি আবার হবে? ওই মোহাম্মদ আলী পিছন পিছন ঘুরতে লাগল। ওকে বললাম, তোর হবু শ্বশুর খুব ছোট লোক,দাবী করলাম পাঁচ হাজার টাকা আর দিতে রাজী হল,মাত্র তিন হাজার টাকা।
আমার কথা শোনার সাথে সাথে মোহাম্মদ আলী আমার হাত চেপে ধরে বলল,উই হবিন মাইজ ভাই, আর ট্যাকা লাইগবি নানে।
এভাবে দর কষাকষিতে সপ্তাহ খানিক চলে যাচ্ছে। মোহাম্মদ আলীর কাজে- কামে মন নেই।
আব্বা বকাঝকা করে, 'এই তুই ঠিকমত কাজ-কাম করিসনি'?
মোহাম্মদ আলী গিজগিজ করে কি যেন বলতে বলতে আব্বার সামনে থেকে সরে যায়। বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে হবে এ রকম ভাবনা আব্বা এবং আম্মার মধ্যেও রয়েছে।যে কারণে বিয়ের দিনও ঠিক করে ফেলল। এক মঙ্গলবার বাদ, পরের মঙ্গলবারে বিয়ে হবে।
মোহাম্মদ আলীকেও হাসতে হাসতে আব্বা বলল, জামেলাকে বিয়ে করে এনে গোয়াল ঘরের পাশের ঘরে থাকবি। কিন্তু মোহাম্মদ আলী ঘাড় না ঘুরিয়ে, একটু কাইত্ হয়ে কিছু জবাব না দিয়ে, চলে গেল বাড়ির বাইরের দিকে। সত্যি সত্যি মোহাম্মদ আলী হারিয়ে গেল। একদিন যায়, দুদিন যায় মোহাম্মদ আলী আর ফিরে আসে না। বাড়ির কাজের চরম সমস্যা হতে লাগল। আম্মার কাজের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতে লাগল। আম্মার রাগ বেড়ে যাচ্ছিল, বলতে লাগল, কন্ গেল?- একটু খুঁজে-টুজে দেখবা তো? এভাবে তো গৃহস্থ বাড়ি চলতে পারে না?
আমরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। এমন সময় একদিন জামেলার বাপ এসে খবর দিয়ে গেল, জামেলাদের বাড়িত থেকেও জামেলা হারিয়ে গেছে।
শেষ-মেষ আব্বা আম্মা খোঁজা-খুঁজি বাদ দিয়ে নতুন কাজের মানুষ নিয়ে এলো। পিকলু এবার একটু ভারী গলায় বলতে লাগল,
তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়তাম। আমারও মনে হয়েছিল, আমি পরীকে নিয়ে মোহাম্মদ আলীর মত পালিয়ে যাব।
কিন্তু সামনে ছিল ফাইনাল পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা শেষ করতে করতে আমার পরী আকাশে উড়ে গিয়েছিল।
আমি তখন একটু জোরে-জোরেই হাসতে থাকি। পিকলু তখন হাটছে আর বলছে,
পরীক্ষা শেষ হলে, রেল স্টেশনে এসে দেখি, জামেলা আর মোহাম্মদ আলী ইন্ডিয়ান কাপড় নিয়ে রেলের বগিতে বগিতে বিক্রি করে বেড়াচ্ছে।
পিকলুর গল্প বলার সাথে সাথে হাটছি ইউএনও সাহেবের বাসার পাশ দিয়ে, ঠিক পুকুরের কাছাকাছি। আবারও পুকুরের পানির মধ্যে মাছ কলবল শব্দ করে উঠল।
আমারও বুকের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল,একটি মাছ আমাদের চেনা-জানা বিল থেকে, ধরতে গিয়ে ফসকিয়ে গেছে।