ঢাকা, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তাহমিনা বেগমের গল্প ‘রুমুর প্রতিজ্ঞা’

তাহমিনা বেগমের গল্প ‘রুমুর প্রতিজ্ঞা’

 
 
এক.
আচমকা রুমুর ঘুম ভেঙে যায়। ও দিশা পাচ্ছে না এখন সময়টা কি দিন না রাত? কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।হঠাৎ দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। বিকাল পাঁচটা বেজে ত্রিশ।এবার মনে পড়লো সব।দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিছানায় কাত হয়েছিল এবং কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। গতরাত থেকে সে একটু বেশীই খাটাখাটনি করেছে। তাই ক্লান্তিতে এই ঘুম। রুমু একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বি. বি.এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল।তাই লাইব্রেরী ওয়ার্ক, ক্লাস, এরপর বাসায় এসেও সেই পড়াশোনা। ওর ভীষণ ইচ্ছা ভালো রেজাল্ট।তারপর বি.বি.এ অনার্স টা শেষ করে দেশের বাইরে চলে যাবে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ফিরে এসে ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া। এটা বলতে গেলে তার জীবনের প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ। একটা সময় রুমু আর দশজন সাধারণ মেয়েদের মতোই ছিল।কিন্তু পরিবেশ এবং সময়ই আজ তাকে এরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে সাহায্য করেছে।তবে কথায় আছে যা কিছু হয় সবই উপরওয়ালার নির্দেশেই হয়। রুমুর বেলায়ও তাই।
 
দুই.
রুমু, রুমু উঠেছিস মা? আচমকা মায়ের ডাকে রুমুর ধ্যানভঙ্গ হয়। এই তো মা, কি হয়েছে? বলে মায়ের ডাকে সাড়া দেয়। চা করেছি খাবি
আয়। আসছি মা বলে রুমু আবারো কি এক ভাবনার সাগরে ডুবে যায়। ওর বাবা থেকেও নেই। লোকটার কথা মনে হলেই একধরনের ঘৃণায় ওর মন বিষিয়ে ওঠে। ওর জগত শুধু মাকে নিয়ে। কত কষ্ট করেন মা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মা একটা সরকারি অফিসে নিন্মমান সহকারী পদে কর্মরত। অনেক অভাব না থাকলেও খুব স্বচ্ছলও নয় ওরা। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন রুমুর মায়ের। রুমু সবসময় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে আসছে। প্রাইমারী ও সপ্তম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে বিনা বেতনে এস.এস.সি তে জিপিএ ফাইভ এবং ইন্টারমিডিয়েটেও জিপিএ ফাইভ পেয়ে সফলতার সাথে পাস করে ঢাকা ভার্সিটিতে বি.বি.এ অনার্সে ভর্তি হয়েছে। এখন একটাই স্বপ্ন ভালো রেজাল্ট আর স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যাওয়া।
 
তিন.
রুমুর জন্মের পূর্বেই ওর বাবা-মায়ের মধ্যে সেপারেশন হয়ে যায়। ও জানতো না। ছোটবেলা থেকেই মা ও নানা নানীসহ সবার কাছ হতে শুনে আসছে ওর বাবা বিদেশে থাকেন। এতোদিনেও ওর বাবা কেন দেশে আসছেন না জানতে চাইলেই সবাই একথা ওকথা বলে পাশ কাটিয়ে উত্তর দিতেন। ছোট্ট রুমু বুঝতো না। রুমুরা ওর নানা-নানীর সংসারেই থাকে। রুমু যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, একদিন বাসার ল্যান্ডফোনে একটি কল আসে। সবাই ব্যস্ত থাকায় রুমুই ফোনটি রিসিভ করে। সালাম দিয়ে জানতে চায়, কে বলছেন? ওপাশে নীরবতা। রুমু আবারো জানতে চাওয়ায় ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে ওঠে, তুমি কি রুমু বলছো? রুমু জী বলছি বলতেই পুরুষ কণ্ঠটি বলে উঠলো, আমাকে ক্ষমা করো মা।আমি তোমার বাবা বলছি। বাবা!রুমু খুশীতে দৌঁড়ে যেয়ে ওর মাসহ বাসার সবাইকে বলে, বাবা ফোন করেছেন। ওর কথা শুনে নিমিষেই সবার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। মুহূর্তেই ওর উচ্ছ্বাস থেমে যায়। কিছুটা থমকে থেকে সবার কাছে জানতে চায় বাবার কথা শুনে সবার মুখ এতো গম্ভীর হয়ে গেল কেন?
 
চার.
রুমুর কথায় মা এবং নানা-নানীসহ সবাই কেমন চুপসে যায়। কেউ ওর কথার উত্তর দিচ্ছে না দেখে ভীষণ ক্ষেপে যায় সবার ওপর। ও দৌঁড়ে রুমে যেয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। ভাবতে থাকে মনে মনে বাবার কথা শুনে সবাই এমন আচরণ করছেন কেন?সেই ছোটবেলা থেকে শুধু শুনেই আসছে, বাবা বিদেশে থাকেন। কখনও চোখের দেখা দেখেনি ও। আজ যাও বা একটি ফোন এলো তাও কথা বলতে পারেনি সবার গম্ভীর মুখ দেখে। ওকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে নানী এগিয়ে আসেন। মা পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা যে এতো তাড়াতাড়ি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন কখনো আশা করেননি। নানীকে দেখে রুমু উঠে বসে। জেদ ধরে। বলে, নানী বলো না বাবার কি হয়েছে? বাবার কথা শুনে তোমরা সবাই এমন গম্ভীর মুখ করে আছো কেন? নানী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, শান্ত হও নানুভাই। সব বলবো তোমাকে। রুমু রুক্ষ কণ্ঠে বলে, এখনই বলো কি হয়েছে আমার বাবার? কেন তোমরা সবাই এমন আচরণ করছো? নানু আর দেরী না করে বললেন, শোনো রুমু তুমি একটু বড়ো হয়েছ। আমরা ভেবেছিলাম তুমি যখন আরো বড় হবে তখন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। প্রয়োজনে তখন তোমাকে সব কথা জানাবো। কিন্তু আগেই যখন পরিস্থিতি এসে গেছে তখন শোনো। তুমি যখন তোমার মায়ের গর্ভে তখনই তোমার বাবা-মায়ের মধ্যে সেপারেশন হয়ে গেছে। রুমু আঁতকে উঠে বলে, এসব তুমি কি বলছো নানী! সেই ছোটকাল থেকে তোমাদের এবং মায়ের মুখে শুনে আসছি বাবা বিদেশে থাকেন। এখন বলছো সেপারেশন! এসব কি শুনছি? বলো বলো কি এমন হয়েছিল যে মা- বাবাকে সেপারেশনে যেতে হলো? নানী বললেন, রুমু তুমি এখনও যথেষ্ট বড় হওনি। বুঝবে না ওসব। শুধু এটুকু জেনে রাখো তোমার বাবা নামের মানুষটা মোটেও ভালো মানুষ নন। সে একটা মুখোশধারী ভদ্রলোক। রুমুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। দুচোখে ঝাঁপসা দেখতে শুরু করে। যে বাবাকে দেখার জন্য দীর্ঘ তেরটি বছর অপেক্ষা করে আছে, সে স্বপ্ন এভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেল? ও আর সহ্য করতে পারলো না।বিছানায় উপুড় হয়ে জোরে কান্না শুরু করলো।নানী স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন। বাকশূন্য। বুঝতে পারছেন না কি করবেন? শুধু মনে মনে ঐ লোকটাকে বকা দিচ্ছেন আর ভাবছেন এতো গোপনতা রক্ষা সত্ত্বেও লোকটা ফোন নাম্বার পেলো কোথা থেকে!
 
পাঁচ.
রুমুর এই তেরো বছরের ছোট্ট জীবনে এতো যে হাহাকার, এতো যে করুণ কাহিনী তার জন্য অপেক্ষা করছে সেকথা ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নানী বললেন, রুমু কান্না থামাও। উঠে বসো, তোমাকে সব বলছি। তোমার মা তখন বি.এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ওর জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব আনেন। পাত্র সুশিক্ষিত, একটি প্রাইভেট ব্যাংকের অফিসার। দেখতে বেশ সুদর্শন। ঘটক বলেন, পাত্রের কেউ নেই। সে একা ঢাকায় থাকে। ভালো ছেলে। আমরা যখন বললাম একটু ভেবে দেখি। ঘটক বললেন, ছেলেটাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। ভাবনার কিছু নেই। ছেলেটি আমাকে একটি ভালো মেয়ের সন্ধান দিতে বললো বিয়ে করবে বলে। তখনই হঠাৎ আপনাদের মেয়ের কথা মনে পড়লো। তাই আমি একদিন আপনার মেয়েকে কলেজ যাবার পথে ছেলেটিকে দেখিয়ে বলি, ঐ মেয়েটিকে দেখো পছন্দ হয় নাকি? একবার দেখেই আপনাদের মেয়েকে পছন্দ করে পাত্র। তাই সে দেরী করতে রাজী নয়। আপনাদের প্রস্তাব দিয়ে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করতে বললো। আরো বললো, তার কোনো দাবী দাওয়া নেই। তোমার নানা সরকারি চাকুরে। তাছাড়া আমাদের তেমন খরচ করে মেয়ে বিয়ে দেবার সামর্থ্য নেই। তোমার আরো পিঠাপিঠি দুই খালা আছে। সব বিবেচনা করে রাজী হলাম। দিনক্ষণ দেখে খুব স্বল্প পরিসরে তোমার মায়ের বিয়ে হয়ে গেল। তোমার মা বরাবরই খুব শান্ত ও চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। সহজে কাউকে কিছু বলতো না। যত কষ্টই হোক নীরবে সহ্য করে যেত। বিয়ের পর তোমার বাবা দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিল। আগে একা একটা রুমে থাকতো। আমরা সাধ্যমত কিছু আসবাব দিয়ে মেয়ে জামাইয়ের সংসার গুছিয়ে দেই। বিয়ের কদিন পরেই দেখি তোমার মায়ের মুখ খুব গোমরা। কেমন চুপচাপ। কারণ কি জানতে চাইলে তোমার মা কোনো উত্তর দিত না। এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে বিয়ের ছ'মাস না পেরুতেই তুমি পেটে এলে। তোমার মায়ের মুখ সবসময় গোমরা, নিস্প্রভ।আমরা বহুবার জিজ্ঞেস করেও কারণ জানতে পারিনি।
 
ছয়.

একদিন বিকেলে আচমকা তোমার বাবা তোমার মাকে নিয়ে এসে রেখে কোনো কথা না বলেই ঝড়ের বেগে চলে যায়। তোমার মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রথম মেয়েটাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখলাম। আমরা সবাই হতবাক। কি হয়েছে মা! তুমি কাঁদছো কেন? জামাই বাবাজী কিছু না বলে এভাবে চলে গেল কেন?
এবার মেয়ে বললো মা-বাবা আমি আর ঐ সংসারে ফিরে যাবো না বলে আরো জোরে কান্না করতে লাগলো। মেয়েটাকে ইচ্ছেমত কাঁদতে দিলাম। ওকে একা থাকতে দিলাম। ভাবলাম কাঁদুক। নিজেকে একটু হালকা করে নিক। পরে সব জানবো। আরো ভাবলাম, হয়তো জামাই বাবাজীর সাথে রাগারাগি হয়েছে। তাই এমনটা বলছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আমরা কিছু জানতে চাইবার আগেই তোমার মা নিজ থেকেই কথা
বলা শুরু করলো খুব শান্তভাবে। সে এক করুণ কাহিনী। শুনে আমাদের আত্মা কেঁপে উঠলো। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম আর বলতে থাকলাম কি করে মেয়েটার এতোবড় সর্বনাশ করলাম? তোমার বাবা একজন মদ্যপ ও অত্যাচারী। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিয়েছে। ঠিকমত খেতে পর্যন্ত দিত না। অনেক কষ্টে তোমার মায়ের কথা শুনলাম। বিয়ের ছ'মাস না যেতেই তোমার মায়ের এই করুণ ইতিহাস। তোমার বাবা পরে অবশ্য কয়েকবার চেষ্টা করেছে। ক্ষমা চেয়েছে। তোমার মাকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু আমরা অনড় ছিলাম। তোমার মা আবার নতুন করে লেখাপড়া শুরু করলো এবং গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করার পর তোমার নানাভাই অনেক
চেষ্টা তদবীর করে যে চাকরীটা করছে ওটা পাইয়ে দিল। কি যে দিনগুলো কেটেছে, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।

সাত.
রুমু একেবারে পাথর হয়ে গেল নানীর মুখে তার মায়ের জীবনের গল্প শুনে। মাথায় জেদ চাপলো ঐ বাবা নামের মানুষরূপী জানোয়ারটার মুখোমুখি হবার। রুমু মনে মনে ঠিক করলো যেভাবে হোক সে ঐ লোকটার সাথে দেখা করবে। তাই সবার অলক্ষ্যে একদিন সে ঐ লোকটাকে ফোন করে তার সাথে দেখা করতে চাইল।
লোকটি সানন্দে রাজী হলো। রুমু তার স্কুলের নাম জানিয়ে বললো পরদিন ছুটির পর উনি যেন ওর স্কুল গেটের সামনে আসেন। রুমু মর্নিং সিফট এ পড়ে। তাই তার স্কুল সকাল এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিটে ছুটি হয়ে যায়। লোকটি যথাসময়ে এলো। এলো সেই সময়। দেখা হলো। কথা বলার জন্য একটি নিরিবিলি স্থানে যেতে বললেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তো কথা বলা যায় না। রুমুর প্রথমে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও পরে যেতে রাজী হলো নিজের কথা ভেবেই। কারণ লোকটির সাথে ওর বোঝাপোড়া আছে। একটা নিরিবিলি রেস্টুরেন্ট দেখে বসলো। বাবা কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে রুমুর দিকে তাকালেন। ও প্রথমেই ক্ষোভের সাথে জানতে চাইলো, কেন তিনি ওর মায়ের জীবন নিয়ে এরকম করলেন? কেনই বা ওর জন্মের পর থেকে আজ অবধি খোঁজ নেননি সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে? কিছুসময় নীরব থেকে বাবা বললেন, মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাদের খোঁজ নেবার কিন্তু তোমার নানা বাসা পাল্টে কোথায় যে গেলেন এবং ফোন নাম্বারটাও পাল্টে ফেলায় অনেক খুঁজেও ঠিকানা পাইনি। তাই..
রুমু ক্ষোভের সাথে বলে উঠলো, এখন পেলেন কি করে? বাবা বলেন, দীর্ঘ বছর খোঁজ করার পর সেদিন হঠাৎ করে তোমার নানার বাড়ীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে একটি দোকানে দেখা। উনার সাথে কথা বলে তোমার কথা জানতে পেলাম। ফোন নাম্বার চাইলে উনি দিতে অস্বীকার করেন। আমার অনেক অনুরোধের পর শেষ পর্যন্ত নাম্বার দেন। নাম্বার পেয়েই আমি ফোন করি যা তুমি নিজেই রিসিভ করেছিলে।

আরো অনেক কথা হয় ওদের মধ্যে। অনেক কথা বলা এবং শোনার পর রুমুর মন কিছুটা নরম হয়।
বাবা রুমুকে বলেন, মা এখন যখন তোমার সন্ধান পেয়েছি আমাকে কিছুটা সুযোগ দাও। আমি তোমার পড়ালেখার ও অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্ব নিতে চাই।

রুমু কিছুসময় চিন্তা করে। হাজার হলেও তার জন্মদাতা পিতা। অনেক ভেবে সে বাবার কথায় সায় দেয়। রুমু বলে, এবার আমাকে বাসার সামনে পৌঁছে দেন।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। ওকে দেখে সবাই আকুল হয়ে জানতে চায় এতো বেলা ও কোথায় ছিল? মা, নানা -নানীসহ সবাই চিন্তায় অস্থির। সবার প্রশ্নের উত্তরে রুমু সত্যি কথাটা বলে। ওর
কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত। এরকম একটা কাজ রুমু করতে পারে কারো মাথায়ই আসেনি।

আট.
এরপর রুমু ওর বাবার সাথে ফোনে এবং বাস্তবে নিয়মিত যোগাযোগ করতে থাকে। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে। কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবা রুমুকে বলে মা এবং নানা-নানীর সংসার ছেড়ে তার বাসায় চলে আসতে। একদিন রুমুকে বাবা জোর করে উনার বাসায় নিয়ে আসেন। ওখানে যেয়ে দেখে বাবার আরেকটি সংসার। বাবা রুনুকে এর আগে একবারের জন্যেও বলেননি যে তিনি আরেকটি বিয়ে করেছেন বা তার সংসার আছে।
এবার আবারো চমকিত হলো ও। ভাবলো জীবনটা এমন কেন! আর কতো দেখতে হবে?রুমু বাবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দিয়ে তাকালে উনি বলেন এখানে যে মহিলা এবং ছেলেটিকে দেখছো এরা হচ্ছে তোমার মা ও একমাত্র ছোট ভাই।

মা! ভাই! এরা কেন আমার মা, ভাই হতে যাবে? আমার মাতো নানীর বাসায়। তাছাড়া আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান।
রুমু আড়চোখে ছেলেটির দিকে তাকায়। বয়স পাঁচ, ছয় হবে। দেখতে খুব মায়াবী। রুমু নিজের রাগ আর ধরে রাখতে পারে না। বাবাকে বলে, তুমি একটা মিথ্যাবাদী। আমাকে এবং আমার মাকে ঠকিয়ে এখানে দিব্যি সংসার করছো। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না। এই বলে ও দরজার দিকে হাঁটা দিল। বাবা অনেক 
বুঝানোর চেষ্টা করলেন ওকে। ঐ মহিলা ফ্যালফ্যাল করে রুমুর দিকে তাকিয়ে থাকলো। শুধুমাত্র ছেলেটি রুমুকে দেখে খুব খুশী। রুমুর হাত ধরে বললো, আপি আপি আসো। বসো। রুমু সব উপেক্ষা করে সিঁড়ি বেয়ে
নীচে নেমে আসলো। বাবাও পিছু পিছু এলেন।

রাগে, অপমানে ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকলো। এই তার বাবা! যে বাবার জন্য এতোটা বছর তার বুকের মাঝে হাহাকার ছিল! ও মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মাকে ত্যাগ করে দিব্যি আরেকটি সংসার সাজিয়ে
বসেছে। ঘৃণায় তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। সেদিন বাসায় ফিরে ও বাসার সবাইকে সব খুলে বলে কান্নায় ভেঙে
পড়লো। সবাইকে বললো, সে একটি ফাঁদে পড়তে চলছিল। আর ফাঁদ পেতে মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিতে
চেয়েছিল বাবা নামের ঐ ঘৃণিত লোকটি।

নয়
রুমু তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকলো মা, মাগো আমি কি ভুলের জগতে ছিলাম ।আমি তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যাবো না। কোথাও না।
রুমু মাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলো, তাকে মানুষ হতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। মায়ের সব দুঃখ সে ঘোচাবে। নানীর মুখে ও শুনেছে ওর জন্মের পর উনারা মাকে বিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু মা কিছুতেই রাজী হননি। শুধু রুমুকে আঁকড়ে ধরে জীবনটা পার করে দিবেন বলে। যে মা এতো অল্প বয়সে এতো দুঃখ নিয়ে জীবনটা পার করে চলেছেন শুধু ওর জন্য, তাঁর মুখে হাসি ফোটাতে হবে। ওকে মানুষ হতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। সেদিন থেকে রুমুর জীবনের একটাই লক্ষ্য, শুধু পড়াশোনা আর ভালো রেজাল্ট।
 

তাহমিনা বেগম