ফাইল ছবি
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান উর্মি, জন্মের পর যখন থেকে বুঝতে শিখেছে। তখন থেকে দেখেছে বাবা-মা তার সবকিছুতে অত্যন্ত সচেতন। কেউ কারো উপর ভরসা করতে পারেনা। বিশেষ করে যখন মায়ের সাথে নানা বাড়ি যেতো তখন দেখতো বাবা ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন দিচ্ছে আমি ঠিক আছি কিনা। কেননা, বাবার ধারণা মা নিজের ভাই-বোনদের পেয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে তার কথা ভুলে গেছে। ঠিক তেমনি মা যদি কোন কাজে বাইরে যেতো হতো তাকে বাবার কাছে রেখে সেও মিনিটে মিনিটে ফোন দিত বাবাকে, আমি কই? ছাদে যাইনি তো আবার, তার ধারণা বাবা টিভিতে কোন প্রোগামে মেতে আছে, আমার দিকে খেয়াল নেই।দুজনের এই আমাকে না পাওয়ার যে ভালোবাসা, তাতে একেক সময় ক্লান্ত হয়ে যেতাম।
বাবা, বরাবরই সোজা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, মানুষকে খুব অল্পতে বিশ্বাস করে ফেলতেন, আসলে এটা বাবার কোন দোষ না, প্রত্যেকটি ভালো মানুষই এমন হয়, নিজের চিন্তা ভাবনা দিয়ে অন্যকে বিচার করে, যাইহোক বাবাও একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আর তাই সে নিজেকে দিয়ে দুনিয়া বিচার করতেন, আর এভাবেই সরল মনে বিশ্বাস করেন ছোটবেলার বন্ধুকে, আর সেই সরলতার সুযোগ নেয় বাল্যবন্ধু। একদিন আমার বাবাকে সবর্হারা করে ব্যবসায় দুই নাম্বারি করে সব আত্মসাত করে নেয়। বাবা তার ছোটবেলার বন্ধু, যাকে সে ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশে কম দেখেনি, তার এই বিশ্বাসঘাতকতা বাবার কমল হৃদয় মেনে নিতে পারেনি, সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই আমার আর আমার মায়ের কাঁধে ফেলে।
আমি আমার বাবার সন্তান, বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকে যে খুব একটা বিলাসিতা জীবন দিয়েছেন তা নয়, তবে যতটুকু প্রয়োজন বাবার সাধ্যের মধ্যে সব সখ পূরণ করেছেন। বাবা সব সময় বলতেন, ভালো স্কুলে পড়তে হয়, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়, যেখানে লেখাপড়া হয়, চাকচিক্যের মাঝে সাধ্য থাকলেও পড়া ঠিক না কেননা সেখানে চাকচিক্যের মাঝে শিক্ষা হারিয়ে যায়। আমি আমার বাবার প্রত্যেকটি কথাকে ভীষণ মূল্যায়ন করতাম। এখনও করি। কেননা আমি সবসময় দেখেছি বাবাকে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরতো, কখনোও গুনগুনিয়ে একটি ইংরেজি গানের উচ্চারণও করতে শুনেনি, আমি ভেবেছিলাম বাবা আমার কোন ইংরেজ গায়ককে চিনেন না।
বাবা, চলে যাওয়ার পর, তার ঘরের আসবাবপত্র সব গুছাতে গিয়ে দেখি তার ড্রয়ারে বাংলা ও হিন্দি গানের সিডি থেকে অনেক বেশি ইংরেজি গানের সিডি সংরক্ষিত, আমি ভীষণ হতবাক্ হই, বাবার চালচলনে কোনদিন তা প্রকাশ পাইনি। তখন বুঝি বাবা সবসময় বলতেন, মানুষ যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। আসলে সবসময় দেখে মানুষকে বিচার করতে হয় না, মানুষের পোশাকে মানুষের পরিচয় নয়, মানুষের ব্যবহার, কথাবলা, মানুষের মানবিকতা, দুর্বলতাকে আঘাত না করা এবং তুমি কারো প্রশংসা করতে না পারো সমালোচনা করবে না, উপকার করতে না পারো, ক্ষতি করবে না। বড় হওয়া মানে সব না তোমার কৃতিত্ব ধরে রাখাটা আসল।
বাবার আদর্শে বেড়ে উঠেছি।
বাবার হৃদয় এত দুর্বল যে বন্ধুর আঘাত সহ্য করতে পারেনি কিন্তু সে তুলনায় আমি আর মা অনেক শক্ত মনের মানুষ, বাবার মত মানুষকে হারানো আমাদের হৃদয় মেনে নিতে পেরেছে, তাই তো বেঁচে আছি, যুদ্ধ করছি জীবনের সাথে, চেষ্টা করছি ভালোভাবে বেঁচে থাকার। আমার ইউনিভার্সিটি পর্ব শেষ, একটা বছর মা বেচারি, অনেক কষ্ট করেছে, আমার লেখাপড়া চালিয়ে নিতে।
বাবার শেষ সঞ্চয় দিয়ে শেষ হল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত জীবন।
বাবার একটাই ইচ্ছে ছিল আমি যেন লেখাপড়াটা শেষ করি, তাই তো মা তার শেষ সম্বল, বাবার কিছু জমানো টাকা আমার পিছনে ঢেলে দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি।
আমার এখন একটাই চিন্তা, একটি ভালো চাকরি যেন পাই, যাতে করে অন্তত ঢাকার বুকে মাকে নিয়ে মান- সম্মান রক্ষা করে বাঁচতে পারি।
তাই সেই চাকরি সুবাদে সরণাপন্ন হই ধনী বড়লোক বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে, যদি কারো সুপারিশে একটা চাকরি জোটে।
সমাজে দেখেছি, যোগ্যতার চেয়ে ক্ষমতার দৌড় অনেক বেশি, তাই যাদেরকে এক সময় এড়িয়ে চলতাম, প্রয়োজনে এখন তাদের কাছে ভিড়ার চেষ্টা করি।
দিন দিন বাড়ি ভাড়া ইলেকট্রিকসিটি বিল সব জমতে থাকে।
মা বেচারি ঐ আমার দিকে তাকিয়ে, কবে একটা চাকরি হবে, কবে চিন্তা মুক্ত হব, জীবন যুদ্ধে কবে যে বাবাকে হারানোর শোকটা ভুলে যাই, মা এবং আমি দুজনেই বলতেই পারবো না। পরিস্থিতি আমাদেরকে বাধ্য করে। আস্তে আস্তে দৈনন্দিন জীবনের সামান্য প্রয়োজনটুকুও বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। রাতের পর রাত আমার ঘুম হয় না, মাও জেগে থাকে, একটা সময় আমি আর সহ্য করতে পারি না।
যেখানে চাকরির খোঁজ পাই সেখানে দৌড়াই, যেকোনভাবে আমার একটা চাকরি খোঁজতে হবে।
এমন অবস্থায়, আমায় হাত বাড়ায় আমার এক বন্ধু, সে আমার অবস্থা বুঝতে পারে এবং তার পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন সে করবে বলে আমায় আশ্বাস দেয়।
আমি ভীষণ খুশী হই এবং মাকে সুসংবাদটি জানাই, মাও ভীষণ খুশি, দুজন-দুজনকে জড়িয়ে অশ্রু ঝরাতে থাকি, বাবার স্মৃতিচারণে পরিবেশ আরও আবেগঘন মুহূর্ত হয়ে উঠে। যাই হোক বুক থেকে যেন এক বিশাল বোঝা নামলো।
রাতে খাওয়া-দাওয়া করে মা এবং আমি বহুদিন পর সুখের হাসি হেসে ঘুমুতে যাই। কেননা, বন্ধুটা বলেছে সকালে ফোন দিবে এবং ফোন দেয়ার সংঙ্গে সংঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপস্থিত হই। ও ওর হাজারো ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করেছে আমার জন্যে।
ভীষণ ভালো লাগলো শুনে নাহ্, পৃথিবীটা এখনও যতটুকু সুন্দর আছে, এসব ভালো মানুষ
আছে। বলে,এখনো পাখির ডাক শুনি, শিশির ভেজা সকাল পাই, আজও ভালো বন্ধু, বন্ধুর বিপদে তার হাতটি বাড়ায় বলে। বাবা চলে যাওয়ার পরে সব কেমন জানি বিষন্ন লাগতো, বন্ধুর বন্ধুত্ব দেখে যেন নতুন করে বাঁচার এক স্বপ্ন খোঁজে পাই। এসব ভাবতে ভাবতে বহু দিন পর শান্তির এক নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ি।
সকালে ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে, ফোন ধরতেই, অপর পক্ষ থেকে বলে, আপনি কি উর্মি বলছেন?
আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসি, বেশ গাম্ভীর্য গলায় একটি লোক, আমায় জিজ্ঞেস করে।
আমি বলি জ্বী বলছি, লোকটি বলে আপনার একটু আমাদের অফিসে আসতে হবে, আপনি খুব সম্ভবত আপনার সিভি দিয়েছিলেন আমাদের অফিসে, আপনাকে সম্ভবত চাকরিটা দেয়া হবে, আপনি দেরি না করে, চলে আসেন, আমি আপনাকে ঠিকানাটা পাঠাচ্ছি। চলে আসুন, দেখবেন দেরি করবেন না যেন। ঠিক আছে তাহলে দেখা হবে bye.
আমি আর কিছু বলার সুযোগ পাই না, হতভম্ব হয়ে শুনতে থাকি, কত অফিসে কত জায়গায় তো আমার সিভি দেয়া। ইতিমধ্যেই লোকটি ঠিকানা পাঠিয়ে দেয়।
আমি, আমার বন্ধুটিকে ফোনে চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু কোনভাবেই ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারি না, পরে মনে হয় ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের কোন কথার মূল্য আছে নাকি?
তারা সবসময় একটি কথা শুধু বলার জন্যে বলে, তাদের একটি কথা যে মানুষের অনেক বড় স্বপ্ন হতে পারে সেই ধারণাই তাদের নেই।
যাই হোক, মা কে জানাই ফোনের ব্যপারটা, মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, যখন বিপদ আসে চারিদিক দিয়ে আসে তেমনি যখন সুখের খবর আসে একটার পর একটি আসতে থাকে..... আমার কপালে চুমু খেয়ে আমাকে বিদায় জানায়।
আমি একটা সিএনজি নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাই, নেমে তড়িঘড়ি করে সিএনজির ভাড়া চুকিয়ে ভিতরে ঢুকি, ১১টার মধ্যে থাকতে হবে, ১১টা ১৫ হয়ে গেছে, প্রথম দিনেই যদি সঠিক সময়ের মধ্যে না থাকি তাহলে এইটা নিয়েও ঝামেলা হতে পারে, সব কিছুর মধ্যেই একটা আতংক কাজ করে। যাই হোক, ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পাই রিসেপশন এ এক ভদ্রমহিলা বসে, কাছে গিয়ে তাকে আমার পরিচয় দিয়ে জানাই, আমাকে ডাকা হয়েছে, সে আমায় ঈশারায় পাশে সোফা রাখা সেখানে বসতে বলে এবং জানায় বস মিটিংয়ে আছে, মিটিং শেষে ডাকবে। আমি বসে থাকি, ভদ্রমহিলার সাথে গল্প করার চেষ্টা করি কিন্তু মহিলা তার ল্যাপটপ থেকে তো মুখ ওঠাচ্ছে না এমনকি চেহারায় একটি বিরক্তির ভাব, যেন কোন কিছুই তার ভালো লাগছে না। আশপাশে কাউকে দেখতে পাই না, হঠাৎ একটি ছেলে দরজা খুলে ঢোকে, ছেলেটার চেহারাটা এত পরিচিত, কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে দেখেছি তা মনে আছে, হ্যাঁ মনে পড়ে, এইতো সেদিন সায়লা ওই যে আমার বড়লোক বান্ধবীর কথা বললাম ওদের আড্ডায় তো দেখেছি ছেলেটাকে, হ্যাঁ সায়লা, আমার সামনেই তো। ওকে বলবো আমার চাকরির ব্যপারে, তাহলে মনে হয় এই ছেলেটির অফিস বা ওর পরিচিত। যাক্ একটু আস্বস্থবোধ করলাম, কিন্তু ছেলেটি এমন ভাব করলো যেন আমাকে চিনতে পারেনি। তাকালোই না। অবশেষে রিসেপশনে বসা মহিলা, আমাকে জানালো বস ডাকছে। তখন আরো নিশ্চিন্ত হলাম, বুঝতে পারলাম এই ছেলেটিই নিশ্চয় বস, আর মনে মনে বললাম আমার ধারণা ভুল, ক্ষমা করো সায়লা, তোমাকে ভুল বোঝাতে, আজকের এই চাকরি যে তোমার জন্য তা বুঝতে পারিনি, তবে একটা ফোন করা উচিত ছিল। ভদ্রমহিলা, আমাকে বলে কি হল চলুন, আমি বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন। আমাকে ভদ্রমহিলা লিফ্ট-এর ছয়তলায় নিয়ে যায়, ঈশারায় দেখিয়ে দেয়, বসের রুম এবং সে চলে যায়। আমার একটু একটু ভয় লাগছে, লাগাটাই স্বাভাবিক, এত বড় অফিস, একদম শুনশান কেমন জানি একটু অদ্ভুত। আস্তে আস্তে বসের রুমের দরজা খুলি, পিছন ফিরে দিখি একটি লোক বসা, সে অবস্থায় আমাকে বলে ওঠে Welcome, Welcome. আমি প্রথম খুব বিব্রত হয়ে যাই, এত বড় অফিস, সেখানে এরকম করে স্বাগত জানানো। আমি দাঁড়িয়ে যাই, বস চেয়ার ঘুরিয়ে আমাকে বলে আসুন আসুন, বসুন।
আমি খুব অবাক হই, আমি যে ভেবেছিলাম, সায়লাদের আড্ডায় যে ছেলেটাকে দেখেছিলাম সে হয়তো বস, আসলে তা নয়, অন্য একটি মধ্যবয়স্ক লোক, তাহলে ঐ ছেলেটাকে যে দেখলাম ঐ ছেলেটা কোথায় গেল? ও কে তো কোথাও দেখতে পেলাম না? বস, কি হল আসুন বসুন, আমি গিয়ে চেয়ার টেনে বসি। বস, আমাকে জিজ্ঞেস করে কি খাবেন বলেন? ঠান্ডা না গরম? বসের এরকম আত্মীয়তা আমাকে আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। আমি বলি না কিছু খাবো না। সে আমাকে বলে, সে কি কথা একটা কিছু খান, আমাদের এখানের কফিটা খুব মজা। বলবো দিতে? আমি তাও না করি, সে কিরকম একটা রহস্যের হাসিমাখা ঠোঁটে আমাকে একটার পর একটা অফার করতে থাকে, একপর্যায়ে আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, আসলে আমাকে এই অফিস থেকে ডাকা হয়েছে, চাকরির জন্য, আমি আসলে জানতে চাচ্ছি, আমার কাজটা কি?
লোকটি আবার রহস্যের হাসি দিয়ে বলে, আরে বলছি বলছি, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? এসছেন যেহেতু সব জেনে যাবেন। আমার, আর ভালো লাগছে না, এবার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি কোন একটা বিপদে পড়েছি। আমি ওঠে যেতেই লোকটি বললো কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছেন? আমি আসি। আপনি যাবেন মানে? আপনি চাকরি করবেন না? এত অধৈর্য হলে হবে? চাকরির প্রয়োজন, টাকার প্রয়োজন অথচ এত অধৈর্য? আমি বললাম, জ্বী আপনি কি বলছেন, আমি বুঝতে পারছি না, আমি আসি। লোকটি, চেয়ার ছেড়ে ওঠে এক পা, দু-পা হেঁটে সামনে আসে এবং আমাকে কথায়, কথায় মানানোর চেষ্টা করে, যখন আমি তার অসাধু আচরণ দেখি আমি ঘাবড়ে যাই এবং দ্রুত ঐখান থেকে পালানোর চেষ্টা করি আর তখনই দেখতে পাই এতক্ষণ যে মানুষটি আমার সাথে এত ভদ্র ব্যবহার করছিল তার পশুরূপ...। মানুষ এত হিংস্র হতে পারে আমার ধারণার বাইরে। আমি হাতজোড় করি এবং বলি আমি টাকা চাই না, আমি একটা চাকরি চাই, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। লোকটি আমার চুল চেপে ধরে আর অশ্লিল ভাষায় গালি দেয় এবং বলে রাখ, তোদের মত বহুত মাইয়া দেখছি এসব নেকামি ছাড়, ভালোই ভালোই যা বলি তা শোন, নাহলে তোর চাওয়া না চাওয়া পরোয়া করবো না, বলেই একটা হুংকার দিয়ে চিৎকার দেয়...। আমি আঁতকে উঠি, ছোটার আপ্রাণ চেষ্টা করি এবং তখনই আমার উপর চালায় অমানবিক নিযার্তন, শারিরীক অত্যাচার, আমি কাঁদতে থাকি আর বলতে থাকি, আমার কি দোষ বলুন? আমার জীবনটা নষ্ট করবেন না প্লিজ, আমি এমনিতেই অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। আমার জীবনে আর কিছু নেই, আমি ভীষণ অসহায়, আমি যত কাঁদতে থাকি, লোকটি তত হিংস্র রূপ ধারণ করতে থাকে। একটা সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, লোকটি আমায় চিৎকার করে উঠাতে থাকে আর বাজে বাজে কথা বলতে থাকে, আমি ততক্ষণে স্বর্বহারা, নিজেকে আর বাঁচানোর কোন চেষ্টাই থাকে না, একটা সময় আমি নিজের সব লুটিয়ে লাশ হয়ে পড়ে থাকি, অকারণে, বিনা অপরাধে গালি শুনতে থাকি...। অপরাধ শুধু ছিল আমি একটা চাকরি করবো, ঢাকার বুকে মাকে নিয়ে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবো।
ঐ অবস্থায় উর্মিকে একটি গাড়িতে করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। উর্মির গাড়ি এসে পৌঁছায় বাড়ির সামনে, গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি যেন নাই। সারা শরীর নিথর হয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে যখন বাড়ি যাচ্ছে, আশপাশের প্রতিবেশীরা, লোকজন এমন করে তাকাচ্ছে উর্মির দিকে, যেন কোন এক নর্দমার থেকে কোন পিশাচ উঠে আসছে।
উর্মির মা উর্মিকে দেখে যেন হতবাক, নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়, সে অপরাধীর মত, উন্মাদের মত ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করতে থাকে।
উর্মি অসুস্থ হয়ে পড়ে। উর্মির মা, সমাজ, আলো, বাতাস সবাইকে ভয় পেতে থাকে, যেন তারা সমাজের এক কলংক, তারাই যেন অপরাধী, ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার বা স্বপ্ন দেখা যেন ভুল।
এই দিকে যখন বাড়ি ভাড়া বাকি ছিল, দিন কাটে না, তখন সমাজ আর সাংবাদিকদের কোন খবর ছিলো না। একটি চাকরি চাওয়ার অপরাধে নিজেকে লুটিয়ে দিতে হল, অন্যায় হল মেয়েটির সাথে, ধোঁকা হল ঠিক, তখনই উর্মিকে পড়তে হল নানান প্রশ্নের সম্মুখীন।
সমাজ, রাজনীতিবীদরা, সাংবাদিক, টিভির টক শো-এর মূল আকর্ষণ উর্মি। উর্মি নিশ্চুপ, তার তো এত বড় স্বপ্ন ছিলো না, তাকে নিয়ে সাড়া দেশ মাতবে।
উর্মির স্বপ্ন তো ছিল অতি ছোট্ট, চাকরি করবে মাকে নিয়ে মানসম্মান নিয়ে জীবন চলবে। এইভাবে নিজের সব লুটিয়ে দিয়ে, সাড়া দেশ তাকে নিয়ে মাতবে সে তো এত বড় স্বপ্ন দেখেনি, চায়ও নি।
সকাল থেকে ফোন সাংবাদিকদের, সমাজসেবকদের, রাজনীতিবীদদের, সুশীল সমাজের, নারী প্রতিবাদী, সবার একেই কথা, জানতে চাই, কিভাবে কি হল? উর্মি চুপ, সে বুঝতে পারছে না কোথা থেকে শুরু করবে, কি বলবে, কি বলবে না.... উর্মি এও বুঝতে পারছে না, সবাই উর্মির কাছে কেন?
নিযাতিত তো সে হয়েছে, বলতেও হবে তাকে?
নিজের কি আর কোন কিছু থাকবে না, সব যখন চলে গেল সমাজ লোক চোখের আড়ালে নিজেকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা, তখন দেশের মূখ্যবস্তু হয়ে গেলাম আমি।
উর্মি দেখছে সবাই সবার কাজে নিষ্ঠার পরিচয় দিচ্ছে কিন্তু আমাকে লুটিয়ে... প্রতিবাদ, প্রতিবাদ প্রতিবাদ..... এত প্রতিবাদের মাঝে আমার বিচার হারিয়ে যাচ্ছে.... প্রতিবাদে বাড়ছে প্রশ্ন, নিজেদের মত করে তারা তারাই প্রশ্ন তৈরি করছে, উত্তরও তাদের কাছে।
কে আমি, নিজেকে মাঝে মাঝে চিনতে ভুলে যাই তাদের নানান প্রশ্নের সামনে। একটা সময় আপন মনে ভাবি.... অনেক আগে রাজারা রাজ্য চালাতেন, সে রাজ্যে যেকোন শ্রেণীর লোকের এমন কি পান্তা বুড়ির ও রাজার কাছে গিয়ে তার অভিযোগ জানানোর সুযোগ মিলত, রাজা তার অভিযোগ শুনে যে বিচার নির্ধারণ করতো তাই ছিল অবধারিত.... কোন প্রতিবাদ ছিলো না, ছিল না কোন প্রচারণাও। ছিল শুধু নায্য বিচার।
সে রাজ্য থেকেই তো শাসন শুরু.... তবে আমরা কেন পারি না?
আমাদের দেশের প্রধান-এর কাছে নিজের আর্জি জানাতে.... কেন এত প্রতিবাদ এত প্রশ্নের ঝড়। যেখানে, শেষ পর্যন্ত নায্য বিচার হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় সে নিস্পাপ মেয়েটির জীবন, যার কোন অপরাধ ছিলো না তবুও অপরাধীর মত তাকেই জবাবদিহি করতে হয়েছিল নানান শ্রেণীর পেশাজীবীদের কাছে।
উর্মি ঠিক করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, আমি যদি কিছু বলি.... দেশের প্রধানের কাছেই বলবো, যদি নিজেকে আর লুটাতে হয়, লুটাবো দেশের প্রধানের কাছে...। সব বলবো তার কাছে.. কোথা থেকে শুরু, কিভাবে কি করলো সব বলবো একটুও দ্বিধাবোধ করবো না, কেননা সব লুটিয়ে যদি নায্য বিচার পাই... আমার যেটুকু আছে তা লুটাতে কোন অসুবিধা নেই... অবশেষে অনেক চেষ্টা, তদবিরের মাধ্যমে সম্ভব হল, আমার স্বপ্ন... পৃথিবীতে আজও ভালো মানুষ আছে প্রমাণ পেলাম, যারা আমাকে আমার স্বপ্ন দেখার ভয় কাটিয়ে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা জোগায়.. যাদের মাঝে সম্ভব হল দেশের প্রধান, আমাদের রাজ্যের রাজা তার কাছে আমার অভিযোগ জানানোর এই আবদারের সাথে সাথে আমার আরেকটি আবদারও ছিল, তাদের কাছে, যারা সবকিছু সম্ভব করলো, আমি তাদের বলেছিলাম, দেশের প্রধানের কাছে আমার এই প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ যেন মিলে এক উন্মুক্ত খোলা মাঠে, যেখানে উপস্থিত থাকবে সব শ্রেণির মানুষ, উপস্থিত থাকতে পারে সব পেশার লোক...। যাদের ছিল হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কৌতুহল, এই কনফারেন্সের মাধ্যমেই আমি সবাইকে জানাতে চাই।
আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, সব সেভাবেই হল।
কনফারেন্স শুরু, উর্মিকে কথা বলার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
এই প্রথম উর্মি তিনমাস পর আকাশ দেখছে, বাইরের আলো দেখছে।
উর্মি হাতে মাইক নিয়ে প্রথমে চুপ করে অবাক দৃষ্টিতে চারিদিক তাকায়, তাকিয়ে বলে- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনার সন্তান, আমি ধন্য আজ আপনাকে, আমার ইচ্ছা সরাসরি বলতে পারার জন্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজকে এ সভায় যত লোক দেখছেন, সে লোকগুলো আমার কথা শুনতে আসেনি... ওরা আমাকে দেখতে এসেছে, কে এই উর্মি?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনার কাছে বিচার চাই। আমি কোন গল্পের নায়িকা নই, আমি সাংবাদিকদের নতুন করে রঙ মিশিয়ে লেখার কোন বিষয় নই, আমি রাজনীতিতে উত্তপ্ত করার কোন কেন্দ্রবিন্দু নই। আমার সাথে যা হয়েছে ঘোর অন্যায় হয়েছে। আমার জীবন শেষ, আমি একথা বলবো না, কেননা, একথা বললে ওই হিংস্র পশুরা জিতে যাবে। আমার সাথে, যা হয়েছে তা অন্যান্য বিষয়ের মত একটি বিষাদ অভিজ্ঞতা।
আমি চাই না, এই নিয়ে গল্প হোক, আমি চাই না, আলোচনার মাঝে আমার বিচার হারিয়ে
যাক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি আপনার কাছে বিচার চাই শুধু বিচার।
এমএস