ফাইল ছবি
অসীম সাহা
দেশজুড়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আর সবকিছুকে আড়াল করে দিয়ে এটিকেই স্বাভাবিকভাবে প্রধান করে তুলেছে। এবারের মতো এমন ভয়াবহ আকারে আগে যেমন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেনি এবং এতো জীবনও কেড়ে নেয়নি; তেমনি সিটি করপোরেশনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং নানা ধরনের নাটক মানুষের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। সময়ের কাজ সময়মতো না করাতে তারা সবকিছুকে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। ফলে যে বিপর্যয় অনিবার্য ছিলো, সেটাই হয়েছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ঢাকা পড়ে গেছে বরগুনার সবচেয়ে সেনসিটিভ বিষয় নয়নবন্ড এবং তাদের সহযোগিদের বীভৎস ভূমিকা। নয়ন গ্রুপের কাছে বরগুনার মানুষ যে জিম্মি, তা বরগুনার বিভিন্ন স্তরের মানুষদের কাছ থেকেই জানা গেছে। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তা সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছে নানামুখী খবর। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে নাম এসেছে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের। তাদেরই ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা বরগুনাতে এতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। কিন্তু ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য প্রথম থেকেই একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। সেই সূত্রে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ৫বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং বর্তমানে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত শম্ভু দেবনাথ ও তার ছেলে সুমন দেবনাথকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নেপথ্যের যেসব কুশীলব ফায়দা লুটতে চেয়েছেন, তারা এখনও তৎপর রয়েছেন।
শম্ভু দেবনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয়। ২১শে পদক পাবার পর জগন্নাথ হল অ্যালামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত অনুষ্ঠানে তিনিও আমার সঙ্গে একমঞ্চে ছিলেন। তখনই পরিচয়। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি, তিনি ছোটবেলা থেকে ছাত্রলীগ করে ধাপে ধাপে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অকুতোভয় একজন সৈনিক হিসেবে আনুগত্যের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। হয়তো তাই তাকে এবং তার ছেলে সুমন দেবনাথকে জড়িয়ে সংবাদপত্রে এমন কিছু সংবাদও প্রকাশ করা হয়েছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যা তার বিপক্ষে গেছে। ছেলে সুমন দেবনাথ যে এর সঙ্গে জড়িত এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন তার পিতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, তার কি কোনো প্রমাণ আছে? যদি থাকে, তা হলে তারও অনুসন্ধান হোক এবং ডকুমেন্টারি এভিডেন্স দিয়ে প্রমাণ করা হোক, রিফাতহত্যায় পিতাপুত্র দায়ী! যদি তা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, এটার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নেপথ্যের কুশীলবদের ‘ঈগলচক্ষু’ গিয়ে পড়েছে শম্ভু দেবনাথ ও তার ছেলে সুমন দেবনাথের ওপর। সারাদেশ হামলে পড়েছে এই দুজনের ওপর। আমার শুধু মনে একটাই প্রশ্ন মনে জাগছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি এতোই বোকা যে, তিনি বরগুনার কোনো খবরই রাখেন না? শম্ভু দেবনাথ যদি এতো খারাপ লোকই হবেন, তা হলে ৫বার তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিলেন কেন? শম্ভু যে এলাকা থেকে বার বার জিতে এসেছেন, সেটি কিন্তু সংখ্যালঘু এলাকা নয়, সেখানে বেশিরভাগ ভোটারই মুসলিম! শম্ভু দেবনাথ এতো খারাপ হলে তিনি কী করে বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভোট পেয়ে ৫বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন? আমার জানা মতে, শম্ভু দেবনাথ আওয়ামী লীগের কোনো ভুঁইফোড় নেতা নন। তার শেকড় আওয়ামী লীগের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অনেকটাই মাটির নীচে প্রোথিত। তা হলে বরগুনায় কারা শম্ভুর বিরদ্ধে মাঠে নেমেছেন? পত্র-পত্রিকায় যেসব সংবাদ এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন হচ্ছেন এর মূল উস্কানিদাতা। তার রাজনৈতিক কৌশল, ‘সাপও মারবো, লাঠিও ভাঙবো না!’ আজ তিনি এবং পরিবর্তিত নামের জনৈক মশিউর রহমান শিহাব সম্পর্কে নানা কথা শোনা যাচ্ছে! শোনা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভেতর কলহ ও দ্বন্দ্ব তৈরির নেপথ্যনায়ক এই মশিউর রহমান শিহাব।
তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, তিনি সার্টিফিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে নামের পরিবর্তন ও শিক্ষাগত সার্টিফিকেট জোগাড় করেছেন। গাড়িচুরির মামলায় একসময় দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। শিহাবের নানা কুকর্মের সঙ্গী বরগুনার কিছু সাংবাদিকও। শোনা যায়, ঢাকাস্থ একটি দৈনিকের বরগুনা প্রতিনিধির সহযোগিতায় শিহাব ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুমন দেবনাথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কুৎসা রটিয়ে মূলত শম্ভুকে হটিয়ে আগামী নির্বাচনে নিজেকে সেই পদে অধিষ্ঠিত করতে চান। অন্যদিকে রিফাত হত্যামামলার প্রধান আসামী রিফাত ফরাজী ও তার ভাই নিশান ফরাজী বরগুনার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। রিফাতের বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরগুনা সদর থানায় অন্তত চারটি মামলা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে আরো নানা কুকীর্তির সঙ্গে জড়িত থেকেও সে পার পেয়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, একদিকে শিহাব অন্যদিকে দেলোয়ারসহ বরগুনার কিছু ছাত্রলীগ নেতাও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে শুধু সমর্থনই দেননি, একইসঙ্গে নিজেরাও তাতে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে বরগুনার রাজনীতি এখন অপরাধমূলক রাজনীতির কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে। এসব তথাকথিত নেতাদের ভূমিকার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ, সে-সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন বরগুনার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। এসব যাচাই করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু এতোদিন ধরে তারাও ঘুমিয়ে ছিলেন বলে মনে হয়। অথবা রাজনৈতিক চাপের কাছে পরাভূত হয়ে তারা নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে দিনরাত্রি পরিশ্রম করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের প্রতি বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়ে যারা দলের মধ্যে কলহ তৈরি এবং চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনায় লিপ্ত থেকে শেখ হাসিনার হাতকে দুর্বল করছে, তারা আসলে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও দলের আগাছা। এঁদের ছেঁটে ফেলা জরুরি। ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুরও এ-ব্যাপারে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। নেত্রীর কাছে এসব ঘটনা তুলে ধরে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তারও। গত কয়েকদিনে নয়ন বন্ডদের কারণে বরগুনা তার সকল সুনাম ধূলিসাৎ করেছে। কিন্তু এখনও সময় আছে, এই নয়ন বণ্ডদের যারা শেল্টার কিংবা ছত্রছায়া দিয়েছেন ও দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার। দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এই সব মোশতাকের বংশধরের শেকড়কে যদি এখনই উৎপাটন করা না যায়, তা হলে এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য নেত্রী শেখ হাসিনাকেও ছোবল দিতে দেরি করবে না। তাই সময় থাকতে তাদের ফণা থেঁতলে দিতে হবে, যাতে তারা কখনও আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়