ঢাকা, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ | ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

নীলা মাহমুদের গল্প ‘কমলা’

নীলা মাহমুদের গল্প ‘কমলা’

এক দম্পতি এবং তাদের সাথে অবিবাহিত একটি বান্ধবী। দম্পতি লন্ডনে থাকে। দেশে ঘুরতে এসে অবিবাহিত বান্ধবীকে নিয়ে সিলেট ঘুরতে যায়। দুই বান্ধবীর অনেক বছর পর দেখা। স্বাভাবিক ভাবেই গল্পের শেষ নেই। বেচারা বান্ধবীর বর একা পড়ে গেছে। কিছু সময় তাদের সাথে কাটালেও তার গল্প বসে বসে শুনতে আর ভালো লাগে না। সে তার স্ত্রীকে বলে, অবন্তি তোমরা গল্প করো আমি বরং একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। অবন্তিও স্বস্তি পায়। কারণ, বোকার মত তার বর বসে তাদের গল্প শুনছিলো সে খুব অস্বস্তিবোধ করছিলো।

সুন্দর পাহাড়ের উপর একটি রির্সোট। চারিদিক শুনশান নিঝুম। চারিদিক যেমন ভালোলাগার তেমন একটু ভয়েরও বটে। বর টা বের হয়ে একটা সিগারেট ধরালো, টানতে টানতে একটু সামনে এগুতেই পাহাড়ের উপর  আঁকাবাঁকা পথ তাকে বেশ আকৃষ্ট করলো। হাঁটতে  হাঁটতে আনমনে বেশ অনেকটা পথ চলে গেছে, পথে তার সাথে এক বুড়ির দেখা হলো। একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসছে।  বুড়িটা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে বললো, বাবা আমার বাড়ীটা ঐ সামনেই। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে কিছু বুঝতে পারছি না। নাতনিটা  যে কোথায় গেলো? বাবা যদি কিছু মনে না করো, আমাকে একটু এগিয়ে দিবে? ঐ তো ঐ ঢালটার সামনেই আমার ঘর। বৃদ্ধার অনুরোধ অবজ্ঞা করতে পারলো না, সে বললো, চলুন।

হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধার সাথে তার অনেক কথা হলো। বৃদ্ধা কত বছর হলো এখানে থাকে, পরিবারে আর কে আছে ইত্যাদি।

বৃদ্ধাও জানতে চাইলো ছেলেটি কেনো এসেছে, একা এসেছে কিনা? যাই হোক, বৃদ্ধার বাড়ী পৌঁছুতেই আরেকটি অনুরোধ করলো। বললো, বাবা যদি কিছু মনে না করো, এক কাপ চা খাবে এই গরীবের ঘরে? খুব খুশী হবো। ছেলেটি বৃদ্ধার সেই অনুরোধটিও ফেলতে পারলো না। বৃদ্ধার বেড়ার ঘর, কিন্তু গুছানো।  এক কাপ চা বানিয়ে বৃদ্ধা ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার হাতে এ চা সবাই খুব পছন্দ করে, তুমি খেয়ে দেখো বাবা তোমারও ভালো লাগবে।

-বাহ্ বেশ তো। এতো সুস্বাদু চা আগে কখনোও পান করিনি। সত্যিই অসাধারণ। এবার তাহলে উঠি। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে আর অনেকটা পথ। বৃদ্ধা বললেন, নাহ্, খুব একটা দূর নয়। একটু  গেলেই তোমাদের বাংলো। কি যে করি? নাতনিটা এখন ও ফিরলো না, ও তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারতো। ছেলেটি বললো, তার দরকার হবে না, আমি একাই যেতে পারবো।

বৃদ্ধা সাবধান করে দিয়ে বললো, সোজা চলে যাবে, পথে কারো সাথে দেখা হলে বা আমার মত কেউ সাহায্য চাইলে তুমি রাজী হইও না। কার মনে কি কেউ তো বলতে পারে না।  যাও বাবা যাও।

বিদায় নিয়ে ছেলেটি চলে আসে। কিন্তু ছেলেটির মনে বৃদ্ধার জন্য একটি মায়া জন্মায়। মনে হয় ভীষণ আপন কেউ। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, এতো অল্প সময় কিন্তু কত আপন করে নিলো বৃদ্ধ মহিলাটি! বয়স হয়ে গেলে বুঝি মানুষ এমনটাই হয়ে যায়! চেনা অচেনা সবাইকে আপন করে আকড়ে ধরতে চা।

দূর থেকে দুটি টর্চ লাইটের আলো দেখা যায়। অবন্তি আর ওর বান্ধবী। দেখা মিলতেই জিজ্ঞেস করলো, কী হলো দুজন কোথায় গিয়েছিলে? কত চিন্তা করছিলাম। এরকম ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে আর তুমি চেনো না কোন কিছু। একা একা কোথায় চলে গেলে? জন বললো, এই তো হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা দূর চলে গিয়েছিলাম, তাই চিনে আসতে একটু দেরি হলো। চলো চলো। আমি কি ছোট বাচ্চা যে হারিয়ে যাবো? তোমরা আমায় খুঁজতে বেরিয়ে গেলে?

অবন্তি: হবো না? কি ভয় লাগছিলো। এমন শুনশান চারিদিক আর তুমি কোথায় চলে গেলে?

বাংলোতে ফিরে এসে জন সব খুলে বললো। ওরা বললো, হুম হতেই পারে, বয়স্ক মানুষ পথ ভুলে যেতেই পারে।

জন : তোমাদের কাল সকালে নিয়ে যাবো। বিশ্বাস করো, এমন মজার চা আমি জীবনে পান করি নাই। তোমাদের নিয়ে যাবো সেই বুড়ির বাড়ী। তোমরা খেলে ও তাই বলবে।

অবন্তি: অবশ্যই যাবো। তার ভালো চা তৈরি করার নিয়মও আমি শিখে নিবো।

সকাল হলো, নাস্তার পর্ব শেষ। এবার জন অবন্তিকে আর ওর বান্ধবী তাড় করলো, চলো যাবে না? অবন্তির বান্ধবী ঠাট্টা করে জনকে বললো, চা দিয়ে তোমায় আবার জাদু করেনি তো? জন হেসে বললো, বৃদ্ধ মানুষ, সে জাদু করে কি করবে?

অবন্তির বান্ধবী বললো, বৃদ্ধ বলেই তো তার পাশে কাউকে প্রয়োজন। জন বললো, ছি! এসব বাজে কথা বলো না। সে তো মায়ের বয়সী মহিলা। বান্ধবী বললো, আরে আমি তো দুষ্টুমি করলাম। জন বললো, রাখো এসব কথা। এবার চলো।

জন অবন্তি এবং তার বান্ধবীকে নিয়ে সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পাহাড়ের শেষ সীমানায় চলে এলো। কিন্তু বুড়ির বাড়ী খুঁজে পেলো না। জন বললো, এ কি ব্যাপার? আমার যতদূর মনে পড়ে, এই ঢালটার সাথেই ছিলো বুড়ির ঘরটা। অবন্তি বললো,  যদি তাই হয়, তবে গেলো কোথায়? রাতের অন্ধকারে তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি, যাই হোক চলো ফিরে যাই। আমরা আরেকটা চা বাগানে যাবো।

জন একটু বোকা একটু হতভম্ব হয়ে বললো, হুম চলো।

ওরা সবাই ফিরে এলো। সারাদিন চা বাগান, আনারস বাগানসহ নানান জায়গায় ঘুরে ক্লান্ত। বাংলোতে ফিরে ওরা খাওয়া দাওয়া শেষে শুয়ে পড়লো। জনের মনে কৌতুহল হলো, কেমন জানি একরকম আকৃষ্টতা। জন অবন্তিকে বললো, তোমরা শুয়ে পড়ো, আমি বরং একটু বাইরে ঘুরে আসি, সিগারেটও খাবো।

অবন্তি: দেখো বেশী দূরে যেও না।

জন: না এই আশেপাশেই আছি।

জন বের হলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু একটু কুয়াশা আচ্ছন্ন। চাঁদের আলো যেন তার সমস্ত আলো দিয়ে চারিদিক আলোকিত করতে চাচ্ছে। অদ্ভুত দৃশ্য। ইচ্ছে হচ্ছে অবন্তিকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াতে, কিন্তু অবন্তি তো বেশ ক্লান্ত। সে এই অপরুপ ক্ষণ তো উপলব্ধি করবেই না বরং আমার অনুভূতিটাও নষ্ট করে দেবে। তবে তার বেশ লাগছে হেঁটে বেড়াতে।

-আরে ওখানে কে?আরে আপনি! এতো রাতে এখানে কি করছেন?

বৃদ্ধা: আর বলো না বাবা। আজও আমার নাতনি টা যে কই গেলো? এখনো ফেরেনি, তাই ওকে খুঁজতে আসা। আর সবে তো এশার আযান দিলো, এতো রাত কোথায়? ফ্যাশ ফ্যাশ গলা কিন্তু উচ্চারণ বেশ স্পষ্ট। কালো বর্ণ গায়ের রং। চুলগুলো সব সাদা ধবধবে। চোখে তার অসাধারণ এক অসহায়বোধ, এক মায়া ভরা দৃষ্টি।

জন: আমি আজ আমার স্ত্রী এবং ওর বান্ধবীকে নিয়ে আপনার বাড়ী যেতে চেয়েছিলাম। এতো খুঁজলাম কিন্তু কিছুতেই বাড়ীটা খুঁজে পেলাম না। আমার স্ত্রীকে আপনার চায়ের গল্প শুনিয়েছি, ও খুব আগ্রহী ছিলো আপনাকে দেখবে, আর আপনার হাতে চা খাবে।

বৃদ্ধা: হা হা হা... তুমি তো বেশ বোকা ছেলে! ঐ যে আমার ঘর , তোমার বাংলোর সামনেই তো আমার ঘর। তুমি নিশ্চয়ই ঐ দিন রাত বলে খেয়াল করোনি। আর তাছাড়া তুমি তো সেদিন এ পথ দিয়ে আসো নাই, অনেক দূরের পথে তোমার সাথে দেখা, তাই ওখান থেকে হেঁটে আসা অনেকটা পথ, এজন্য বুঝতে পারোনি। তো যাও না, এখন ডেকে নিয়ে আসো তোমার বউকে।

জন : নাহ্। ওরা খুব ক্লান্ত। সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে তো তাই শুয়ে পড়েছে।

কথা বলতে বলতে জন দেখলো, ও প্রায় বুড়ির বাড়ীর কাছে চলে এসেছে। বেড়ার ঘরে কুঁপি জ্বালানো, কেমন জানি এক অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য ।

বুড়ি জনের দিকে তাকিয়ে বললো, খাবে নাকি এক কাপ চা?

জন হেসে  বললো, এসে যখন পড়েছি, খাওয়া যায়।

বুড়ি জনকে ভিতরে আসতে বললো। বুড়ি চা বানাচ্ছে আর জনের দিকে মিট মিট করে তাকিয়ে হাসছে। জন ভয় পেয়ে যায় আবার একটু সংকোচবোধ করে। হঠাৎ লক্ষ করে বুড়ি আচঁল দিয়ে চোখের পানি মুছছে। এবার জন কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন?

বৃদ্ধা হেসে বললেন, এ কান্না নয় বাবা। এ জল আনন্দের জল।

জন একটু হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের আনন্দ?

বৃদ্ধা : এই ক্ষণটির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি, কেউ একজন আসবে এবং তাকে আমি আমার মনের সব কষ্টের কথা বলবো, সেই অপেক্ষায়ই দিন ফুরিয়ে গেছে,.... অবশেষে তুমি আসলে।

জন যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বৃদ্ধার অসহায় চাহনীতে যেন তার বুকের আর্তনাদ দেখতে পারছে।

জন: বলুন আপনার কি কষ্ট?

বৃদ্ধা  সামনে এগিয়ে এসে জনের হাতে চা তুলে দিয়ে পাশে বসলো। তারপর বলতে লাগলেন,

কমলা নামে একটা মেয়ে ছিলো। চৌদ্দ কি পরেনো বছর বয়সে বিয়ে হইছে। সবে স্বামীকে নিয়া চা বাগানে চা-পাতা তুলে সংসার চলে। চা তুলে যে টাকা পায়, কোনমতে মাস চলে। কোনদিন ঘরে খাবার জুটে তো কোনদিন জুটে না। অল্প বয়স, স্বামী তারে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু তারে যদি অভাবের কথা কয়, তয় রাতে আবিজাবি খাই তারে পিডায়। এভাবে কাটতে থাকে জীবন। কিন্তু স্বামী মেলা ভালোবাসে কমলারে।

তার এই ভালোবাসায় কমলা অভাব ভুইল্লা যায়। একদিন তোমরা যে বাংলোতে উঠছো, সেহানে এক ইংরেজ সাহেব আইলো।তার টুকটাক কাজ কমলার স্বামী কইরা দিতো। একদিন কমলা তার স্বামীরে ডাকতে গেলো সাহেবের বাড়ীতে। সাহেব কমলারে দেখলো।

পরের দিন কমলার স্বামী আইসা কমলারে কইলো, কমলা শোন, ঐ সাহেব কইছে, তুই যদি ঐ সাহেবের কাজ করোস, তাইলে দুইজনে মেলা টাকা পামু।

কমলা প্রথমে রাজী হইলো না। এমন উচা লম্বা!  কমলার কেমন জানি ভয় লাগলো। কিন্তু কমলার স্বামী কইলো, ভয় কিসের আমি আছি না?

জন লক্ষ করলো, বৃদ্ধা যেন গল্প বলতে বলতে সেইদিনে চলে গেছে। জন একটু উঠবার চেষ্টা করলো। বললো, অনেক রাত হয়ে গেছে।  আমি এবার যাই, বাকিটা না হয় পরে শুনবো।

বৃদ্ধা একটু কষ্ট, একটু অভিমান আর একটু ক্রোধের সাথে বললো, কি হয় একটু রাত হলে? খুব বেশী অন্যায় তো হয় না। কমলার সাথে যে অন্যায় হইছে, তা শুনবার জন্য একটু রাত না হয় হোক। কত অপেক্ষার পর আমি তোমাকে পাইছি। আজ রাতের পর আর দেখা না ও তো হতে পারে।

বুড়ির সেই আকুতি জন ফেলতে পারে না। জন বলে, শুনবো, সবটাই শুনবো। কিন্তু আমায় আর এক কাপ চা দিতে হবে। আর একটা কথা বলতে হবে, এই গল্প আমাকেই কেন শুনতে হবে?

আর কমলাটা কে তা বলুন তো?

বুড়ি হেসে বললো, চা ও দিবো তোমার কথার উত্তরও দিবো।  

জন বললো, বলুন তারপর কি হলো?

বুড়ি বললো, প্রথমে চা তোলার পর টুকটাক কাজ করে কমলা সাহেবের বাড়ীতে যায়। পরে সাহেব টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, চা তুলতে হবে না। সারাদিন যেন তার বাড়ীতেই কাজ করে।

সাহেব অনেক সাহায্য করে কমলাকে। তার স্বামী একবার পেটের ব্যথায় মরি যায় যায়, কি করবে বুঝতে না পাইরা কমলা সাহেবকে গিয়া বলে। সাহেব তার স্বামীকে অনেক বড় ডাক্তার দেখাইলো, ঔষধ পানির সব ব্যবস্থা কইরা দিলো। এছাড়াও নানান রকম সাহায্য সহযোগিতা সাহেব করতো।

বুড়ি: এই নাও তোমার চা।

কমলার হাতে সাহেব এই চা খাইতে খুবই পছন্দ করতো। বলতো, কমলা আমি যখন ফেরত যাবো, তোমার এই চা টা খুব কি কয় জানি?

জন : মিস করবো

বুড়ি : হুম ঐডা করবো।

সাহেবের এই ভালোবাসায়, আদর আপ্যায়নে দিন দিন কমলা ও তার স্বামীর সাহেবের উপর একটা ভরসা আইসা পড়লো।

একদিন সাহেব কমলার স্বামীরে দূরে একটা কামে পাঠাইছে, আর কমলার কাম করতে করতে রাত হইয়া গেছে। বাইরে হঠাৎ তুফান শুরু হইছে, কমলা চিন্তায় শেষ। কমলার স্বামী কই? কমলা কেমনে বাড়ী যাইবো?

সাহেব কমলারে কইলো, কমলা চিন্তা কইরো না, তুমি বসো তোমার স্বামী ঠিক আইসা তোমায় নিয়া যাবে।

কমলা সাহেবের সামনে বসলো। সাহেব গ্লাসে কইরা কি জানি লাল লাল রংয়ের পানি খাইতাছে। একসময় সাহেব কমলারে কইলো, কমলা তোমার ইচ্ছা হয় না তুমি অনেক বড়লোক হও? তুমি মেম সাহেব হও? তুমি গাড়ীতে চড়ো?

কমলা হাইসা কইলো, কতকিছুই তো ইচ্ছা হয় সাহেব। সবকিছু কি সম্ভব? আমরা গরীব, কোনমতে কাজ কইরা পেট চালাই। এইসব স্বপ্ন দেহোনও আমাগো পাপ।

সাহেব কমলারে কইলো, না কমলা, তুমি চাইলে এখনো তোমার জীবন সুন্দর করতে পারো। তুমি দেখতে কত সুন্দর! অভাব অনটনে তোমার মুখখানা অমন হইয়া গেছে। তুমি ভালো থাকলে অনেক সুন্দর দেখাবে তোমায়।

এমন সময় কমলার বর আসলো। কমলা বরের সাথে বাড়ী ফিরে গেলো। বাড়ী ফিরে কমলা আর ঘুমাতে পারে না। সহজ সরল মনে বিশ্বাস করে সাহেব কমলাকে যা বলছে, তা কি সত্যি?

কমলা পরদিন কাজে যায়, কমলার চোখে যেন মেম সাহেব হওয়ার স্বপ্নের রেশ তখনোও কাটে নাই। কমলা কাজ করে আর চিন্তা করে, সত্যি যদি কমলা মেম সাহেব হতে পারতো!

সেদিনই হঠাৎ এক মেম সাহেব আসে সেই বাংলোতে গাড়ীতে চড়ে। সে কমলাকে ভীষণ আদর করে। কমলার মুখমন্ডল, শরীরের গঠন দেখে মেম সাহেব অভিভূত হয়। কমলা মেম সাহেবকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভাষা না বুঝলেও যেন মনের ভাষা আর চোখের ভাষায় দুজন দুজনকে বুঝতে পারে।

একদিন মেম সাহেব জোর করে কমলাকে ওর কাপড় পরায়। কমলা লজ্জায় প্রথমে মুখ ঢেকে রাখে দু’ হাত দিয়ে। পরে আস্তে আস্তে তাকায় আয়নায়। কমলা যেন নিজেকে চিনতে পারছে না, সে যেন সত্যি সত্যি মেম সাহেব হয়ে গেছে! মেম সাহেব হওয়ার স্বপ্ন কমলার মনে গভীর হতে গভীর তরে হতে থাকে।

দু’দিন পর মেম সাহেব চলে যায়, কমলার আর কোন কাজে মন বসে না। সে এখন মেম সাহেব হওয়ার স্বপ্নে মগ্ন।

সে সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, কি করে সে মেমসাহেব হতে পারবে?

সে কমলাকে স্বপ্ন দেখায়। সে কমলাকে বিয়ে করে বিলেত নিয়ে যাবে। এজন্য সে যা যা বলবে কমলার তাই করতে হবে।

দিনের পর দিন অভাব দেখতে দেখতে কমলা তার স্বামীর ভালোবাসাকে হার মানায়। সে তার স্বামীর ভালোবাসা ভুলে গিয়ে মেম সাহেব হবে, এই স্বপ্ন দেখতে থাকে।

চারিদিকে সবাই তাকে সাবধান করে। এমনকি তার স্বামীও তাকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কমলা সবাইকে তার স্বপ্নের শত্রু এমনকি তার স্বামীকেও হিংসাত্মক  ভেবে কারো নিষেধই মানে না সে। দিন রাত এখন সাহেবের সাথে থাকে। স্বামী চারপাশের কানাঘুষায় লজ্জায় কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

একদিন কমলা জানায়, সে তার স্বামীর সাথে আর থাকবে না। অচিরেই সাহেব তাকে বিয়ে করবে। সে বিলেত চলে যাবে। কমলার স্বামী ক্রোধ সামাল দিতে না পেরে দৌড়ে যায় ঐ সাহেবের বাড়ীতে। গিয়ে দেখে, সাহেব নাই। সাহেব রাতের অন্ধকারে চলে গেছে। কমলার স্বামী বুঝতে পারে, কমলার সাথে কী হইছে। সে দৌড়ে আসে বাড়ীতে। দেখে, কমলা অসুস্থবোধ করছে। ডাক্তারের কাছে জানতে পারে, কমলা অন্তঃসত্ত্বা লজ্জায়, অপমানে কমলার স্বামী আত্মহত্যা করে। তার স্বামীর এই দৃশ্য কমলা সহ্য করতে না পেরে সেও আত্মহত্যা করে।

বুড়ি : এই যে আমার বাড়ীর ঢালটা, এখানেই দু’ জন আত্মহত্যা করে।

জন : আপনি বললেন না, কমলাটা আপনার কে?

বুড়ি : পরে বলবো। আজ অনেক রাত হয়েছে।  চল তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসি।

বুড়ি  জনকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়।

 

জন ফিরে দেখে, অবন্তি আর তার বান্ধবী বেলকুনিতে বসা। তারা চিন্তিত।

অবন্তি রেগে গিয়ে বললো, এটা কোন কথা? কোথায় চলে গিয়েছিলে? ফোনও Switched off!

জন : একটু শান্ত হও, সব বলছি। ফোনের Charge শেষ হয়ে গিয়েছে।

চল ভোরের আলো তো ফুটেই গেছে, চল তোমাদের নিয়ে যাই ঐ সামনেই বুড়ির বাড়িতে।

অবন্তি: আবার বুড়ির বাড়ি? হলো টা কি বলো তো তোমার?

জন : আহা কিছুই হয়নি, আজও দেখা হয়ে গিয়েছিলো ঐ বুড়ির সাথে। তার মুখে একটি গল্প শুনতে শুনতে কখন যে সময় চলে গেছে, টের পাইনি।

গার্ড ম্যান আসলো, স্যার কোথায় ছিলেন? কত জায়গায় খুঁজলাম আপনাকে। আমরা তো ভয় পাইয়া গেছিলাম।

জন : আরে নাহ্।  ঐ যে সামনে বুড়ির বাড়ি, ঐ খানে ছিলাম।

গার্ডম্যান: বুড়ির বাড়ি মানে? এই পাহাড়ের আশেপাশে তো কোন বাড়ি নাই।

জন : আছে চলুন।

সবাইকে নিয়ে জন এপাশ ওপাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজলো, কিন্তু কোন বুড়ির বাড়ি বা কেনো কোন বাড়িই পেলো না। ঐ ঢালটার সামনেও গেলো, তাকিয়ে দেখলো, কোনভাবে পা পিছলে পড়লে বাঁচার কোন সম্ভবনা নাই। এই ঢালের উপরই তো ছিলো সেই বুড়ির বাড়ি। পথে তার ফেলে যাওয়া সিগারেটের অংশবিশেষও দেখতে পেলো। জন চুপ হয়ে গেলো এবং বুঝতে পারলো, কমলা নামের যে মেয়েটির গল্প তাকে শুনিয়েছে বুড়ি, সে কমলা অন্য কেউ নয়, ঐ বুড়িই ছিলো সে কমলা।

ফেরার পথে জন চারপাশে তাকায় আর ভাবে, সবুজে ঘেরা এই সুন্দর চা বাগান উঁচু উঁচু পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে আসি আমরা, আর এই সবুজের মাঝে এই সুন্দর চা বাগানে কত কমলার আর্তনাদ, তা কি আমরা শুনতে পাই?

তাই তো সব কমলার সাক্ষী হয়ে এক কমলা তার বুকের আর্তনাদ শুনিয়ে গেছে আমায়। আমরা তো ভুলে গেছি,  কিন্তু যে কমলারা ধোকা খেয়ে প্রাণ দিয়েছে তারা ভোলেনি ব্রিটিশদের অন্যায় অবিচার। কত জিদ, কত ক্ষোভ থাকলে আজও তারা ঘুরে ফিরে লন্ডন থেকে আসা কোন প্রবাসিকে জানাতে চায়, তাদের সাথে কি হয়েছিলো? কত অত্যাচার জুলুম তাদের সইতে হয়েছিলো, কত কমলার প্রাণ গিয়েছিলো মিথ্যা স্বপ্নচারীর কারণে…।