ফাইল ছবি
আনিসুজ্জামান আনিস। একজন সংস্কৃতিমনা ও বিনোদনপ্রেমী মানুষ। বন্ধুপ্রিয় এবং সহজ সরল সাদা মনের এই মানুষটি পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর কাজ করে চলেছেন। নিরলস কাজ করে যে কয়জন ফ্যাশন ডিজাইনার বাংলাদেশে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজকে ব্র্যান্ডিং করে ফ্যাশন ডিজাইনিংকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন, আনিসুজ্জামান তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও নামী ফ্যাশন হাউজ স্টাইলপার্ক এর ডিজাইনার ও সত্ত্বাধিকারী। আবার তিনি একজন বিখ্যাত ফ্যাশন কোরিওগ্রাফার। পাশাপশি একজন টেলিভিশন নাটকের প্রযোজক। সামনের বছরেই তিনি আবার চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া আনিসুজ্জামান পরিকল্পনা করছেন আমেরিকা – বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় বাংলাদেশী ছবি নির্মাণ করার। এই জন্যেই আমেরিকার লগ্নিকারকদের সঙ্গে মিটিং করতে চলতি মাসের ২৪ তারিখে আমেরিকার নিউইয়র্কে যাচ্ছেন তিনি। যদিও বর্তমানে তিনি ওখানেই স্থায়ী ভাবে থাকছেন। নিউইয়র্ক থেকে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট এ তার স্টাইলপার্ক গার্মেন্টস আইটেম সরবরাহ করছেন। এবার গিয়ে নিউইয়র্কে নিজের ফ্যাশন হাউজ স্টাইলপার্ক এর শাখাও চালু করবেন বলে জানালেন আনিসুজ্জামান আনিস। সম্প্রতি ছায়াছন্দ অনলাইনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় মেতেছিলেন গুণী মানুষ আনিসুজ্জামান আনিস, যাকে ভালোবেসে তার পরিচিতরা তার ফ্যাশন, স্টাইল ও গেটআপ এর কারণে “বাংলাদেশের বাপ্পী লাহিড়ী বলে ডাকেন।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পছায়াছন্দ অনলাইনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আনিসুজ্জামান আনিস শুরুতেই কথা বললেন তার ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে আসার এক চমকপ্রদ ঘটনা। তিনি বলেন, আমার বাবা আলহাজ্ব প্রয়াত মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন রাজনীতিবিদ। তিনি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার সংসদ সদস্য ছিলেন। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি আর্মি অফিসার হই। ওই জন্যেই তিনি আমাকে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। ওখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমি আইএসএসবি করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এর প্রশিক্ষণে যোগ দেই। কিন্তু আমি সহ মোট ২৬ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ শেষ না করে পালিয়ে আসি। পাল্টা প্রশ্নে তার কাছে পালিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই চাকুরী আমাকে টানতো না। কারণ স্কুল জীবন থেকেই আমি খুবই ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ ছিলাম। টেইলারিং দোকানে গিয়ে নিজের পোশাক নিজেই ডিজাইন করে বানাতাম। তখন থেকেই আমার নেশা ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার। এই জন্যে ট্রেনিং থেকে পালিয়ে এসেছিলাম।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পপরবর্তীতে ঢাকায় এসে আনিসুজ্জামান আনিস ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্রের নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মান্না, দিতি, সোহেল চৌধুরী, শেলী কাদের, মিঠুন, সাত্তারদের সঙ্গে নতুন মুখের নায়ক নির্বাচিত হন। কিন্তু বাবার আপত্তির কারণে তিনি চিত্রনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করে ১৯৮৬ সালে “ডিয়ার্স আই” নামের একটি ফ্যাশন হাউজ চালু করেন। শুরুতে মেয়েদের শাড়ি ও থ্রি পিস ডিজাইন করতেন। তিনি জানান, এরপর ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়া চলে যান। ওখানকার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে তিন বছর মেয়াদী কোর্স কমপ্লিট করে দেশে ফিরে আসেন। নব্বই দশকের শুরুতে “ডিয়ার্স আই” এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন “স্টাইলপার্ক”। তখন মেয়েদের আইটেমের পাশাপাশি ছেলেদের ক্যাজুয়াল শার্ট, ফ্যাশনেবল শার্ট, পলো, টিশার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবী এসব ডিজাইন শুরু করেন তিনি।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পকথায় কথায় নিজের ফ্যাশন হাউজ স্টাইলপার্ক এর বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বলেন, এটির শাখা আগে ঢাকা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ছিল। এখন কলাপাড়ার শাখাটি মাদার ব্রাঞ্চ। ঢাকায় আমাদের নিজস্ব মার্কেট বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট থেকে সারাদেশে হোলসেল করা হয়। এছাড়াও মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকা সহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে আমার ডিজাইন করা লেডিস ও জেন্টস গার্মেন্টস আইটেম স্টাইলপার্ক ব্র্যান্ড হিসেবে রপ্তানী করা হচ্ছে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল – রপ্তানীর ক্ষেত্রে কেমন সাড়া পাচ্ছেন ? তিনি বলেন, অনেক ভালো সাড়া পাই বলেই তো আমেরিকার নিউইয়র্কে এটির শাখা খোলার প্রস্তুতি চলছে। ইচ্ছে আছে আরও কয়েকটি দেশে শাখা খোলার। সেই রকম প্রস্তুতিও আমার আছে। আমি আমার দেশের ব্র্যান্ডকে বহির্বিশ্বে শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখি। আর সেই লক্ষ্যেই আমি স্টাইলপার্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পএবার আপনার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন। আপনি তো নতুন মুখের নায়ক নির্বাচিত হয়েও বাবার আপত্তিতে অভিনয় করেননি। পরবর্তীতে তো বর্তমান চলচ্চিত্রের সুপার শাকিব খানকে নিয়ে একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন ? আপনি ঠিকই বলেছেন। “প্রেমের চিঠি” নামের ওই ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন মোস্তফা আনোয়ার। এরপর নাটকও প্রযোজনা করেছি। একক ও ধারাবাহিক মিলিয়ে অর্ধশতাধিক টিভি নাটক নির্মাণ হয়েছে আমার প্রযোজনা সংস্থা “মায়ের আঁচল” এর ব্যানারে। মেজবাহ শিকদার, চয়নিকা চৌধুরী, শরাফত জীবন, বি ইউ শুভ সহ অনেকেই আমার নাটক পরিচালনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক হলো সোনালী দিন, একাত্তরের আমি, মিছা কথার মেশিন, মনে কী দ্বিধা, রঙিন ফানুস ইত্যাদি। আমার প্রযোজিত কিছু নাটকে আমি অভিনয়ও করেছি।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পএকজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার ও ফ্যাশন কোরিওগ্রাফার হিসেবে আনিসুজ্জামান আনিস দেশে বিদেশে অনেক সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাবিসাস, বিনোদন ধারা, চিত্রজগত, ডিসিআরইউ এবং আমেরিকার এনআরবি অ্যাওয়ার্ড। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরস্কার একজন মানুষের পেশাগত কাজে অনুপ্রেরণা দিয়ে তার কর্ম দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। আমি মনে করি, এসব পুরস্কার আমার পেশাগত কাজকে যেমন স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনি আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে সম্মান জানিয়েছে। যারা আমার মেধা প্রতিভার স্বীকৃতি জানিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছে, আমি তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। এসব সম্মানজনক পুরস্কার আমার আগামীর দিনগুলোতে আমাকে পেশাগত কাজের স্পৃহা আরও বাড়িয়ে তুলবে বলেই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
সফল ফ্যাশন ডিজাইনার আনিসুজ্জামানের গল্পসবশেষে আনিসুজ্জামান আনিস এই প্রতিবেদককে বলেন, ফ্যাশন ডিজাইন কিম্বা নাটক প্রযোজনার বাইরে চলচ্চিত্রের প্রতি, চলচ্চিত্রের মানুষের প্রতি আমার অসম্ভব রকম ভালোবাসা রয়েছে। তাই তো আবারও আমি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করার পরিকল্পনা করেছি। ইচ্ছে আছে আমেরিকা – বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় আন্তর্জাতিক মানের একটি বাংলাদেশী ছবি নির্মাণ করার। ব্যয়বহুল এই ছবিটি নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি আমার কমপ্লিট। আমেরিকার কয়েকজন লগ্নিকারকের সঙ্গে আমার প্রাথমিক আলাপ হয়েছে। এবার গিয়ে তাদের সঙ্গে আবার মিটিং করবো আমার এই স্বপ্নের প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের মাঝামাঝি আমি ছবিটির নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারবো। অন্যদিকে আমেরিকায় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র রপ্তানী করার বিষয় নিয়েও আমার পরিকল্পনা রয়েছে। সেটিও এবার গিয়ে ফাইনাল করবো।
আরকে