ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ৭ মাঘ ১৪৩১ | ২০ রজব ১৪৪৬

নীলা মাহমুদের গল্প ‘খোকন’

নীলা মাহমুদের গল্প ‘খোকন’

ছবি : সংগৃহীত

বাবা বিরাট শিল্পীপতি আলিশান বাড়ি গাড়ি বয়, বেয়ারা, সবকিছু সাজানো গুছানো, ড্রয়িংরুমের শোপিস যেমন যত্ন করে রাখা তেমনি সবার কথা বার্তা ও ব্যবহারে একটা মাধুর্য গুছানো পরিপাটি, মাত্রার বাইরে তাদের ভালোবাসাও যেনো নিয়ম কানুনে সীমাবদ্ধ।

একেক সময় রিয়া হাঁপিয়ে উঠে এই নিয়ম কানুনের বাঁধাধরায়।

যখন বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় যাই তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দেখে ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় ওদের আদরের কোন সীমাবদ্ধতা নেই, নেই কোন ভালোবাসার বাঁধা ধরা নিয়ম।

ওদের জীবন যেনো আমাদের চেয়ে অনেক সুখের অনেক আনন্দের.... আমাদের এই আলিশান বাড়িতে এতো চাকচিক্যতার মাঝেও যেনো সেই সুখ নেই, যেই সুখ ওদের ওই ছোট্ট ফ্লাটে আছে, সবাই একসাথে বসে গল্প করা, একসাথে খাবার খাওয়া যেগুলো আমাদের বাড়িতে কখনো হয়না।

বাবা কখন বাড়ি ফিরেন জানিও না আর মা তার কাছে যাওয়া মানে তো কোন প্রয়োজনে।

আমার ওই আলিশান বাড়ির চেয়ে যে ওদের বাড়ি আরও সুন্দর আর ও সুখের, বন্ধু বান্ধদের সাধারণ জীবনকে ভালোবাসতে বাসতে প্রেমে পড়ে যাই। এক সাধারণ ছেলের, নাম তার অভি।

সাধারণ বলতে ধনদৌলত নেই কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী ও ভদ্র, বুঝা যায় ভালো পরিবারের সন্তান এবং সুদর্শনও দেখতে।

অভির সাথে আমার কোনদিন কথা হয়নি, সবসময় অভি আমাকে এড়িয়ে চলে, শত চেষ্টার মাঝেও আমি ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে পারিনি, তবে অভি বোঝে আমি অভিকে পছন্দ করি।

হয়তো তাই ও আমাকে এড়িয়ে চলে মনে করতে পারে বড়লোকের মেয়ে হিসেবে ওর সাথে সম্পর্ক করা। এটাও আমার একটা সখ,

সাধারণত সে একটু চুপচাপ অন্য কোন মেয়েদের সাথেও তার কোন ঘনিষ্ঠতা নেই, তার এই স্বভাব আমাকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে।

অভি আমার দিকে কোনদিন ঘুরেও তাকায় না, আমি চেষ্টার পর চেষ্টা চালিয়ে যাই কিভাবে অভির সাথে বন্ধুত্ব করবো, অনেক চেষ্টা আর সাধনার পর অবশেষে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়, তবুও অভি অন্যসব বন্ধুর সাথে যেমন আচরণ করে আমার সাথে কোথায় যেনো একটা দূরত্ব, একটা সংকোচবোধ কাজ করে, আমাকে একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে, যেটা আমি একদম পছন্দ করি না, আমি চাই সব বন্ধুর সাথে অভির যেমনটা সম্পর্ক ঠিক। আমার সাথে ওতেমনটাই হোক। আমরা এখন রোজ এক সাথে সময় কাটাই সিনেমা দেখতে যাই , রেস্টুরেন্টও খাই, আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করি আমার প্রতি যেনো ধর্ণাঢ্য পরিবারের কন্যা আমি অভিকে সেইদৃষ্টি ভঙ্গি থেকে নিজেকে বের করতে এবং ওদের ভিতর থেকে ও সেই চিন্তা ভাবনা দূর করতে। একদিন বিকেলে বসে সবাই গল্প করছি হঠাৎ এই প্রথম দেখি অভি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তাকাতেই ও লজ্জাবোধ করে এবং বলে জানিস রিয়া আমি ভাবতেই পারিনি তুই এতো একটি অমায়িক মেয়ে, ভেবেছিলাম এতো বড়লোকের মেয়ে তোর অনেক অহংকার, সাহসও করতে পারিনি কোনদিন তোর দিকে তাকাবো। রিয়া হেসে বলে, এখন কি দেখলে?

অভি বলে, আসলে তোর সংস্পর্শে না আসলে বুঝতেই পারতাম না তুই এতো ভালো একটি মেয়ে। অভির সাথে পরিচয় হওয়ার পর এই প্রথম ওর মুখে এতো কথা শুনলাম। ওর কথা শেষ হতেই আমি জোরে হেসে উঠি, আর বলি অভি থামো থামো আমার পা কিন্তু মাটিতে নেই, না থামলে আমি কিন্তু উড়ে যাবো, অভি লজ্জা পেয়ে আমাকে বলে, তুমি তো আমায় ভয় পাইয়ে দিলা, আস্তে আস্তে ক্ষণে ক্ষণে অভির মনে আমার ভালোবাসার স্থান পায়। সময়ের সাথে সাথে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং দু’জন দু’জনকে পাগলের মত ভালোবাসতে থাকি। অভি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে ঠিক। কিন্তু ওর মাঝে সবসময় একটি ভয় কাজ করে কেনো জানিও আমার ভালোবাসার উপর আস্থা রাখতে পারে নি , অভি প্রায় আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে আমার পরিবার কিছুতেই আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবে না, অভি বলে আমি শুনি কারণ আমিও ভালো করে জানি আমাদের এই সম্পর্ক কিছুতেই বাবা মা মেনে নিবে না, অভির শিক্ষা মেধা এবং সুচরিত্র কোনটাই প্রাধান্য পাবে না বাবা মায়ের কাছে, কারণ তাদের স্ট্যাটাস তো ধূলায় মিশে যাবে। কিভাবে মুখ দেখাবে তাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে মেয়ের বর কিংবা শশ্বড়বাড়ি কিভাবে উপস্থাপন করবেন তারা। মেয়ের সুখের চেয়ে যে তাদের এ ব্যাপারগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

রিয়া : অভি তুমি কি আমায় ভালোবাসো নাকি আমার বাবার ধন সম্পদকে?

অভি : এ কেমন কথা রিয়া, আমি শুধুই তোমাকে ভালোবাসি, আমি শুধু তোমাকে চাই, আমার মত করে।

রিয়া : তাহলে চলো বিয়ে করে ফেলি।

অভি : তোমার পরিবার মানবে না আমায় রিয়া।

রিয়া : তাই তো বলছি, আমার পরিবারের কোন প্রয়োজন নেই, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, শুধু আমাকে পাবে তুমি, ভুলে যাবে আমি কোন বড়লোকের মেয়ে ছিলাম, পারবে এভাবে আমায় গ্রহন করতে ?

অভি : অবশ্যই পারবো কিন্তু রিয়া তুমি কি পারবে? তোমার লাক্সারি জীবন বাদ দিয়ে আমাদের মত সাধারণ জীবন যাপন করতে?

আমি কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি আমি পরিবারের বড় ছেলে আমার অনেক দায়িত্ব এবং আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার, তুমি কি পারবে রিয়া এসব মেনে নিতে?

এটা কিন্তু খেলা কথা নয় রিয়া, এটা জীবনের অনেক বড় এক সিদ্ধান্ত তুমি ভেবে দেখো ।

রিয়া : অনেক ভেবেছি, অনেক শুনেছি আমি ক্লান্ত এ জীবনে আমি এখন তোমার সাথে কোন নিয়ম কানুনের বাইরে একটি জীবন কাটাতে চাই অভি।

রিয়া : এটা এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যপার নয়, আমি চাই না তুমি এমন কিছু করো যা নিয়ে জীবনে কোন অনুশোচনা থাকে।

অভি, তোমাকে আমি বলেছি, আমি ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তবুও তুমি এ কথা বলছো কেনো?

তুমি কি আমাকে একা গ্রহন করতে চাচ্ছো না?

রিয়া মানে কি একা মানে?

অভি তুমি জানো আমি এভাবে বিয়ে করলে আমার বাবা মা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবে এবং আমি তাদের সব ধন সম্পদের থেকে বঞ্চিত হবো, রিয়া ছি: তুমি কি বলছো?

ঠিক আছে তুমি যা চাও তাই করবো, কারণ আমি শুধু তোমাকে, শুধুই তোমাকে ভালোবাসি রিয়া।

অবশেষে দিনক্ষণ ঠিক করে আবেগকে সামাল দিতে না পেরে ওরা দু’জন বিয়ে করে ফেলে,

যেমনি বলেছিলো তাই হলো রিয়ার বাবা মা কিছুতেই ওদের বিয়ের ব্যাপারটা মানতে পারে না এবং গ্রহনও করে না, অভির বাবা মা তাদের সাধ্যমত যতটুকু সম্ভব আন্তরিকতার মাঝে নববধূকে গ্রহন করে নেয়।

অভির পড়াশুনা শেষ হয়নি সুতরাং সে পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করে বিয়ে করাতো মুখের কথা নয়, একটি বিশাল দায়িত্বও বটে। অভি টিউশনি করে আর অভির বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় ওদের। ওদের জীবন অনুযায়ী ওদের চাহিদা।

একদিকে রিয়ার বাবা মনে মনে ভাবে হাজার ভুল করুক সন্তানকে তো জীবন থেকে বাদ দিতে পারি না, অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াকে মেনে নেয়া।

এই দিকে রিয়াও ব্যাকুল হয়ে আছে বাবা মায়ের জন্য, জন্মদাতা পিতা মাতাকে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? এ যে রক্তের বন্ধন, রক্তের টান স্বার্থের অনেক উর্ধ্বে।

বিয়ে হয়েছে ছয় মাস হয়ে গেলো, রিয়া বড় পরিবারের মেয়ে হয়েও অভির মধ্যবিত্ত পরিবারের সব নিয়ম কানুন মেনে নিয়ে সুন্দরভাবে সব কিছু সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে।

আবেগ আর বাস্তবতার মাঝে যে কতটা ফারাক আছে, আবেগে ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যা কিছু বলা যায়, বাস্তবে তা মনে নেয়া যে কতটা কঠিন তা রিয়া আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে।

এক সকালে রিয়ার বাবা মা গাড়ি নিয়ে হাজির হয় রিয়ার বাড়িতে... রিয়া তাদের দেখে যেনো ভূত দেখছে, রিয়া তার বাবা মায়ের বুকে এবং রিয়ার বাবা মা রিয়াকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের আগমনে, অভি এবং অভির পরিবার এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যে মনে হয় আকাশের চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে, তাদের এই ব্যতিব্যস্ততা রিয়ার খুব খারাপ লাগে, একটি মায়ার বন্ধনে যে সে বাঁধা পড়েছে রিয়া তা বুঝতে পারে।

রিয়া, তাদের শান্ত হয়ে বসতে বলে এবং বাবা মা, শশ্বড় শাশুড়িকে বসিয়ে গল্প করার সুযোগ দিয়ে নিজে অভির বোনকে নিয়ে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

রিয়ার মা ভীষণ অবাক হয়, যে মেয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতো না সে মেয়ে চা করছে আমাদের জন্য ?

অবশেষে রিয়ার মা জানায় যে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য তারা রিয়াকে এবং অভিকে নিয়ে যেতে এসেছে।

রিয়া মায়ের মুখে একথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।

কতদিন কত মাস এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম, বাড়ি যাবো আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার বারান্দা, খুশীতে রিয়া আত্মহারা হয়ে পড়ে.... কারো অনুমতির প্রয়োজন আছে ভুলে গিয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে থাকে।

রিয়া ব্যাগ গুছায় আর ভাবে, আমি ঠিকই বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে চলে আসতে পেরেছি কিন্তু তারা এতো কষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও আমাকে ফেলতে পারিনি, আমার কত অভিযোগ তাদের প্রতি অথচ আমিও তো তাদের সেভাবে কখনোও কাছে টানতে পারিনি।

এমন সময় অভি এসে ডাকে রিয়া,

রিয়া , আঁতকে উঠে, বলে বলো। অভি খেয়াল করে রিয়ার চোখে মুখে হাসির জোয়ার, অভি বলে, রিয়া তুমি যাও, আমি এখন যাবো না।

রিয়া মানে কি অভি, আমার বাবা মা এসেছেন আমাদের দু’জনকে নিতে, চিন্তা করতে পারো, তারা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, আমি তা স্বপ্নেও ভাবিনি আর তুমি বলছো এখন তুমি যাবে না? তারা কষ্ট পাবে না?

অভি, আমি বলিনি যে আমি যাবো না , তবে এখন যাবো না, পরে আসবো , আর রিয়া তুমি তো আমার বাবা মা কিংবা আমাকে জিজ্ঞেসও করলে না তোমার যাওয়ার ব্যাপারে, আমাদের কোন আপত্তি নেই, অবশ্যই যাবে এ খুবই খুশির বিষয় তোমার বাবা মা আমাদের সম্পর্ককে মেনে নিয়েছেন কিন্তু যেহেতু এখন তুমি এ বাড়ির বউ, সেই ক্ষেত্রে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিলো না তোমার?

রিয়া, আমি বুঝতে পারছি না, আমার বাবা মা এতো মাস পর আমাদের মেনে নিয়ে আমাদের গ্রহন করতে এসেছেন এখানে অনুমতির কি প্রয়োজন?

অভি, নাহ্ ঠিক আছে তাহলে, তুমি যা ভালো মনে করো, তুমি যাও, আমি তোমার বাবা মাকে বুঝিয়ে বলছি, আমার একটু কাজ আছে , কাজ সেরে আমি চলে আসবো।

রিয়া যেনো এ জগতেই নেই, বলে আচ্ছা বাবা আচ্ছা, যা ভালো মনে করো, বলে দৌড়ে ব্যাগ নিয়ে ছুটে আসে বাবা মায়ের কাছে, অভি তাকিয়ে থাকে রিয়ার চলে যাওয়ার দিকে, এ যেনো অন্য রিয়া, অচেনা কোন এক মেয়ে,।

অভি, রিয়ার বাবা মাকে বলে, আমি রাতে আসবো, তারা বলে ঠিক আছে, তারা রিয়াকে নিয়ে চলে যায়।

রিয়া নিজের বাড়িতে এসে যেনো স্বর্গে এসেছে, যে বাড়ি যে বাড়ির নিয়ম কানুন একসময় তাকে অসহ্য করে তুলতো এখন যেমন সে সবকিছুতে স্বর্গীয় অনুভূতি পাচ্ছে।

অভি রাতে আসে, রিয়া অভির আগমনে অস্থির হয়ে পড়ে, অভিকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, একেক জায়গায় নিজের একেক স্মৃতির গল্পে আবেগে আপ্লুত, কিছুক্ষণ পর পর দৌড়ে মায়ের বুকে মাথা বাবার বুকে মাথা, আহ্লাদে গদগদ, পুরোপুরি যেনো অন্য রিয়াকে দেখতে পায় অভি, এই রিয়ার সাথে যেনো তার কোন পরিচয় নেই।

অভি যত সময় যেতে থাকে তত বুঝতে পারে কতটা সমঝোতা আর ত্যাগের মাঝে রিয়া অভির বাড়িতে বসবাস করেছে এবং এই সমঝোতা আর ত্যাগ আর বেশীদিনের জন্য নয় তাও অভি উপলব্ধি করে।

রিয়া ভীষণ আনন্দিত নিজের বাড়িতে আর অভি সারারাত ছটফট করে রিয়াকে হারানোর ভয়ে।

অভি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের মাঝে যদি একটি সন্তান আসে তাহলে সে আর রিয়াকে হারাবে না।

দু’দিন পর অভি রিয়াকে বাড়ি ফেরার কথা বলে, রিয়া মন খারাপ করে বলে চলো না আর ক’দিন পর যাই। এমনি করে এক সপ্তাহ পরে অনিইচ্ছাকৃত রিয়া অভির সাথে অভির বাড়ি ফিরে।

এবার রিয়া বুঝতে পারে জন্মগতভাবে সে যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তার কাছে এ জীবন মেনে নেয়াটা কতটা কঠিন, কতটা অসম্ভব।

আস্তে আস্তে রিয়ার মাঝে পরিবর্তন আসতে থাকে, এ রিয়া যেনো সে রিয়া নয়, যে রিয়া অভির হাত ধরে সমস্ত কিছু মেনে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলো, রিয়ার এই পরিবর্তন অভির বাবা মা এবং বোনের চোখেও পড়ে, রিয়া যেকোন বাহানায় অভির সাথে ঝগড়া করা, নানান ব্যাপারে অভিযোগ করা, সুযোগ পেলেই বাড়িতে চলে যাওয়া , এ যেনো রোজকার দিনের একটি নিয়ম হয়ে গেছে।

একদিন হঠাৎ রিয়া খুব অসুস্থ হয়ে যায়, মাথা ঘুরে পড়ে যায়, তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়, জানতে পারে রিয়া অন্ত:সত্ত্বা.... সবাই আনন্দে উৎফল্লিত হয়, কিন্তু রিয়া কিছুতেই ব্যপারটা মানতে পারে না, কারণ সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিয়া আবার পড়াশুনা শুরু করবে, এটা তার জীবন নয়।

এমন সময় অভি আসে, এসে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খেয়ে বলে, এ পৃথিবীর সব চাইতে সুখের খবর আজ তুমি আমায় দিয়েছো, আমি ভীষণ খুশি, অভির চোখে মুখে আনন্দ দেখে রিয়াও সব ভুলে যায়। অভি রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, ভালোবাসি রিয়া, তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।

রিয়া অভিদের বাড়ি ফিরে আসে, অভির মা বোন বাবা সবাই রিয়াকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত, তাদের সাধ্যমত তারা চেষ্টা করছে রিয়া কিভাবে ভালো থাকবে খুশি থাকবে, কিন্তু রিয়া কিছুতেই যেনোভালো থাকতে পারছে না, তার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসে, সে তার বাড়িতে যেতে চায় কিন্তু অভিকে ছাড়াও সে থাকতে পারবে না.... রিয়া সারাক্ষণ উদাসীন মন মরা হয়ে থাকে।

রিয়া অভিকে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝতে পারে না যতবার অভির সামনে যায় ততবারই সে বাকহীন হয়ে পড়ে, সাহস করতে পারে না।

অভির বাবা মা অভিকে জানায় রিয়ার এই অন্যমনস্ক মনোভাব উদাসীন, হয়ে থাকা, তারা অভিকে জিজ্ঞেস করে রিয়ার এই আচরণের কারণ কি? এতে তো রিয়া এবং বাচ্চার দু’জনের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে।

অভি, রিয়াকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? রিয়া প্রথমে বলতে না চাইলেও পরে বলে, সে আর এ বাড়িতে থাকতে চায় না।

অভি, কোন রকম প্রতিক্রিয়া না করে রিয়াকে বলে, তুমি চাইলে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তুমি থাকতে পারো।

রিয়া অভিকে জানায় সে তাদের বাড়িতেও যেতে চায় না, এবার অভি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে তার মানে কি তাহলে কোথায় যাবে?

রিয়া জানায়, আমার আর তোমার বাড়িতে, অভি বলে মানে? রিয়া বলে মানে আমি প্রয়োজনে চাকরি করবো, তবুও আমি চাই তোমার আর আমার একটা বাড়ি।

অভি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলে রিয়া এটা কি আমাদের বাড়ি না? আর তাছাড়া তুমি তো জানো আমি বড়, আমি কি পারি আমার বাবা মা বোনকে ফেলে চলে যেতে?

রিয়া বলে, আচ্ছা অভি তুমি কি আমার সাথে আমার বাবা মা আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকবে? যদি তুমি থাকতে না পারো, তাহলে আমি থাকতে না চাইলে আপত্তি কোথায়? আর আমি বলিনি তাদের ফেলে চলে যেতে তাদের প্রয়োজনে যা লাগে সব করবো আমরা, সে জন্যে একসাথে থাকতে হবে কেনো? অভি তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, আমার ভীষণ কষ্ট হয়, দুটো বাথরুম আমি আর পারছি না,

রিয়া এতোদিন তো পেরেছিলে, আর তুমি তো জেনেই এসেছো এখন কেনো পারছো না।

অভি তুমি কি আমার কথা শুনবে, নাকি না, তোমাকে আমি আমার কষ্টের কথা বলেছি তুমি যদি না পারো বলে দাও, এতো কথা বলছো কেনো? হ্যাঁ আমি অস্বীকার করছি না, আমি বলিনি তবে আমার এখন কষ্ট হচ্ছে, আমি কি তোমাকে জানাতে পারবো না ? আমার কষ্টের কথা।

না রিয়া আমি তা বলিনি একশোবার আমায় বলবে, কিন্তু আলাদা হওয়ার কথা বলছো তাই আমি মন খারাপ করেছিলাম,

অভি শোন আমি কোন ভনিতা জানি না নাটকও করতে পারি না, দু’দিন পর পর অভিযোগ না করার চেয়ে একেবারে সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো। রিয়া তার মানে তুমি এখনোও বলছো, এ কথা?

অভি , হ্যাঁ আমি আর থাকতে পারছি না, হয় তুমি আলাদা বাসা নিবে, না হয় আমি আজকে চলে যাচ্ছি, আমি আমাদের বাড়িতে থাকবো।

রিয়া রিয়ার বাবার বাড়ি চলে যায়।

দিনের পর দিন যায়, অভির বাবা মা বুঝতে পারে, অভি রিয়াকে ছাড়া ভালো নেই এবং বাবা মায়ের দায়িত্বও এড়াতে পারছে না। অভির বাবা অভিকে বলে বাবা এখন তোমার একটা জীবন হয়েছে, একটি সংসার, ক’দিন পর নতুন একজন অতিথি আসবে তোমাদের মাঝে, তোমাদের ভালোবাসার বন্ধন। আমি আমার দায়িত্ব করেছি তোমার মা তোমাদের দায়িত্ব পালন করেছি, এখন তোমার দায়িত্ব তোমার স্ত্রী এবং আগামী অতিথির ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেয়া, রিয়া যা চায় তুমি তাই করো, আমরা তোমার বাবা মা সবসময় তোমার পাশে ছিলাম আছি থাকবো, ভালোবাসতে হলে দায়িত্ব করতে হলে এক সাথে থাকতে হয় কে বলেছে? তুমি দূরে থেকেও তুমি তোমার দায়িত্ব করতে পারো কিন্তু এভাবে রিয়ার সাথে আমাদের এবং তোমার সবার সম্পর্কে তিক্ততা আসবে। অভিকে বুঝিয়ে অভির বাবা মা রিয়ার বাড়িতে পাঠায়।

অভি রিয়ার বাড়িতে বেশকিছু দিন পর যায়, গিয়ে দেখে রিয়ার শারীরিক পরিবর্তন,কেমন জানি একটা অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে, রিয়া নিজেকে আর সামলে নিতে পারে না দৌড়ে গিয়ে অভিকে জড়িয়ে ধরে। অভি রিয়াকে জানায় , রিয়ার সিদ্ধান্তের সাথে অভি এবং অভির পরিবার একমত, রিয়া প্রচন্ড আনন্দিত, সাথে সাথে সে স্বপ্ন দেখা শুরু করে, কেমন হবে তাদের নতুন সংসার, স্বপ্নে বিভোর রিয়া, আর অভি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় রিয়ার দিকে।

পরের দিন রিয়া যথারীতি উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে অভির অপেক্ষায়, অভি এলে ওরা ওদের নতুন বাড়ি খুঁজতে বের হবে এমনটাই কথা হয় অভির সাথে রিয়ার গতকাল।

অভি আসে রিয়াকে নিয়ে বের হয়, রিয়া ভাবনা আর অভির আয়ের অনেক ব্যবধান তাই রিয়ার এটা পছন্দ হলে অভির সাধ্য ভেবে চুপ হয়ে যায়, অবশেষে অভির আয় এবং রিয়ার মোটামুটি পছন্দমত একটা বাড়ি পায়।

সব গুছগাছ করে রিয়া দ্রুত ঐ বাড়িতে উঠে যায়।

রিয়া এখন খুব খুশি, অভির পছন্দের খাবার করা, তার জন্য অপেক্ষা করা, দু’জনে একান্তে সময় কাটানো বেশ ভালো দিন কেটে যাচ্ছে ওদের, মাঝে মধ্যে রিয়ার বাবা মা, অভির বাবা মা-রাও আসেন। অভি ও খুব খুশি রিয়ার খুশি দেখে, এখন অভি আর শুধু টিউশনি করে না একটি চাকরি করে পাশাপাশি টিউশনি করে, ঢাকার বুকে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকা কিচারটে খানি ব্যাপার আর শুধু তো তা নয় বড় সন্তান হিসেবে তার তো বাবা মায়ের উপরও দায়িত্ব আছে। কিন্তু অভি যেনো সারাদিন চাকরি আর টিউশনি করে রাতে বাড়ি ফিরে রিয়ার সাথে গল্প করা তাকে সময় দেয়া নিজের সাথে পেরে উঠে না, খুব ক্লান্তবোধ করে, এদিকে রিয়া যেনো বুঝতেই নারাজ অভির এই ক্লান্তির ব্যাপার যত দিন যাচ্ছে তত যেনো রিয়ার চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, অভি যেনো রিয়ার একেক চাহিদা পূরণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, একটার পর দুইটা টিউশনি নেয়, কিভাবে কি করবে বুঝতে পারে না। দিন চলে যায় সময় ঘনিয়ে আসে রিয়ার বাচ্চা হবার।

এক সন্ধ্যায় অভির ফোনে আসে রিয়াকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অভি ছুটে যায়, গিয়ে দেখতে পায়, রিয়া আর অভির ভালোবাসার স্মৃতি রিয়া এক পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন, অভি অভির পরিবার রিয়ার পরিবার সবাই খুশি, আনন্দে আত্মহারা।

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, হাজারো যুদ্ধ, অভিযাগ, অভিমান আর সমঝোতার মাঝে কেটে যেতে থাকে অভি আর রিয়ার সংসার জীবন তাদের ছেলে অমিকে নিয়ে। অমি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে স্কুলে পড়ে, রিয়া অমিকে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ততার মাঝে দিন কাটায়, কিন্তু রিয়ার বুকের মাঝে একটাই কষ্ট দিন দিন বাড়তে থাকে সে যেভাবে বড় হয়েছে সে তার একমাত্র সন্তান অমিকে সেভাবে বড় করতে পারছে না, অভি একটা ব্যাপারে ভীষণ অমত তার ছেলে কারো পয়সায় মানুষ হবে না তার সন্তান তার আয় অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, কিন্তু রিয়া যে তা মানতে পারে না রিয়ার শৈশব কেটেছে সম্পদের মাঝে কোনকিছুর অভাব সে কখনোও বুঝতে পারেনি গাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া, সাথে আয়া আরো কত কি তার নিত্য নতুন জিনিস দেখার জন্য ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা উদগ্রিব হয়ে থাকতো আর তার ছেলে রিক্সায় করে যাওয়া আসা, সুখ তো দূরের কথা প্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খেতে হয় রিয়া এবং অভির।

একদিন রিয়া অমির ছুটির পর রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে এমন সময় অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়, রিয়া আর অমি দু’জনেই ভিজে চুপচপ হয়ে বাড়ি ফিরে, অমি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবার যেনো রিয়ার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে নিজের জীবনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, অনেক সমঝোতা করেছি কিন্তু সন্তানের সাথে যেনো আর কোন সমঝোতাই করতে পারছে না..... রিয়া অপেক্ষায় থাকে অভি বাড়ি ফেরার, অভি বাড়ি ফিরে ক্লান্ত, রিয়া যেনো কিছুই বুঝতে পারে না, অভিকে গিয়ে অমিকে বৃষ্টিতে ভিজে আসার কথা খুব ব্যথিত হয়ে বলে। অভি বলে আমিও অনেক ছোটবেলা বৃষ্টিতে ভিজেছি তাতে কি হয়েছে? রিয়া, নিজেকে সামাল নিতে না পেরে চিৎকার করে বলে, আমি ভিজিনি, আমার সন্তানও ভিজবে না, তুমি একটা গাড়ি কিনো, আর যদি না পারো তবে বলো, আমি আমার বাবাকে বলছি, আমার বাবা আমাকে কিনে দিবে। অভি বলে, আমার পক্ষে গাড়ি কিনা সম্ভব নয় রিয়া তুমি তা ভালো করে জানো, আর আমার সন্তানের জন্য অন্য কেউ গাড়ি কিনে দিবে তা আমি কখনোও হতে দিবো না, রিয়া বলে, অন্য কেউ মানে? সে আমার বাবা, আর তুমি যদি বাবা হয়ে সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে না পারো তবে তোমার এতো আত্মঅহংকার কিসের? এক কথা দু-কথায় অভির সাথে রিয়ার প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি হয় এবং রিয়া সাফ জানিয়ে দেয়, অমির সাথে কোনরকম সমঝোতা সে করতে পারবে না সুতরাং সে অমিকে নিয়ে রিয়া রিয়ার বাবার বাড়ি চলে যাবে..., বাবা মায়ের চিৎকার চেচামেচি অমি আড়াল থেকে সব দেখে..... শিশুমনে অমির তার বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হয়।

রিয়া অমিকে তার বাবার বাড়ি চলে যায়।

রিয়ার বাবা মা রিয়াকে অনেক বুঝাবার চেষ্টা করে কিন্তু রিয়া তাদের বলে, যদি তোমরা আমাকে তোমাদের বোঝা মনে করো তাহলে আমি অন্য বাড়ি নিয়ে চলে যাবো তবুও অভির কাছে ফিরবো না। অভি এবং অভির পরিবার সবাই রিয়ার সাথে দেখা করতে চায় কিন্তু রিয়া ওদের কারো সাথে দেখা করে না, এমনকি ছেলেটিকে পর্যন্ত দেখা করতে দেয় না।

আস্তে আস্তে দিন যায় মাস যায় মাস গড়িয়ে বছর কেটে যায়, অভি অনেক চেষ্টার পর নিজেকে ব্যর্থ ভেবে সে নিজেকেও দূরে সরানোর চেষ্টা করে, রিয়া যেনো তার সন্তানকে মানুষ করতে পারে সেই ভেবে।

রিয়া আর অভির বাড়িটি অভি ছেড়ে দেয়, কোন অপেক্ষায় কার অপেক্ষায় আর থাকবে অভি , শুধু শুধু এতোগুলো টাকা দিয়ে বাড়িভাড়া করে না থেকে সে তার আগের ঠিকানায়। তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যায়।

একদিন সকালে অভি একটি কাগজ পায়, রিয়া অভিকে ডির্ভোস লেটার পাঠিয়েছে, অভি চুপচাপ সই করে দেয়।

অনেক বছর কেটে যায়, রিয়ার বাবা মা-এর মধ্যে চিরবিদায় নেয়, অমি ও বড় হয়ে গেছে এখন আর রিয়ার অনুমতির অপেক্ষায় সে থাকে না, তার ইচ্ছেমত সে তার বাবার সাথে দেখা করে।

জীবন কারো জন্য অপেক্ষা করে না সে চলে তার গতিময়ে, অভির জীবনে একজন আসে তার অফিসের কলিগ, সে যেনো অভির মনের সকল ব্যথা অভির চিন্তা ভাবনা সব বুঝতে পারে, সে অভিকে খুব ভালো করে বুঝতে পারে অভিও যেনো তেমনটাই দু’জনের এই মনের মিলনে তাদের মাঝে প্রথমে বন্ধুত্ব পরে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধহয়।

এদিকে রিয়া বয়সের সাথে সাথে নিজেকে চিনতে শিখে, বুঝতে পারে, অভির সব জেনেশুনে সে অভির জীবনে প্রবেশ করেছিলো, অভি তাকে সব বলেছিলো, সে সব মেনেই অভিকে গ্রহন করেছিলো তবু কেনো এমন হলো, কেনো আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলাম.... এক বিকেলে হঠাৎ তার ছটফট লাগে, এক টুকরো কাগজের জন্য, একটি চিঠি, অভির চিঠি,

বাইরের ঝিরিঝিরি বাতাসে বুকের ভিতরে একটা চিনচিনে ব্যথা হয় একটা হাহাকার, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি কেন এমন হয়?

যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি তা তো ছিল এক তিক্ততার সম্পর্ক, জীবন হয়ে গিয়েছিল বিষাদময়, প্রতিটি মূহুর্ত কাটতো যন্ত্রণায়, কবে কেমন করে ভালোবাসা পালিয়ে গেল জীবন থেকে বুঝতে পারিনি, যখন বুঝেছি ততক্ষণে একছাদে বসবাসের বিষয়টি অসম্ভব হয়ে গেছে...... অবশেষে মুক্তির চুক্তি, সবকিছুই ঘটে গেল চাওয়া মাত্র,

কেননা, বুঝতে পেরেছি অপু,

সেও ভুগছিল একেই রোগে বিচ্ছেদের অপেক্ষা ছিল তারও মাঝে।

একটি মাত্র পুত্র পাঁচ বছরে নানা শ্রাবণ, বৃষ্টি, ফাগুনের মত সম্পর্কের মাঝে কোন এক সমঝোতায় অমি, আসে আমাদের জীবনে, তখন থেকেই চেষ্টা, হাজারো তিক্ততার মাঝে খরি ধরে বেঁচে থাকার মত, আমি আর অপু দু'জনই চেষ্টা করি অমিকে একটি পরিবার দেয়ার, শেষ পযর্ন্ত আমি এবং অপু দু'জনই হার মানি নিয়তির কাছে,।

ক্লান্ত হয়ে পড়ি জীবনের হার জিত খেলায়..... বিচ্ছেদ ছিল সমঝোতার মাঝে, হাজারো অভিযোগ, অপমান, অপবাদ কত কিছুই না ছিল দু'জনার....। হঠাৎ, আনমনে এলোমেলোভাবে খুঁজতে থাকি এক টুকরো কাগজ, ভুলেই যাই জিদ অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে সব কাগজ পুড়িয়ে দিয়েছিলাম কোন এক সন্ধ্যার মোমবাতিতে, যে কাগজে ছিল আমার আর অপুর ভালোবাসার সাগরে ভাসার হাজারো মধুর স্মৃতি,

যেগুলো একসময় গলাচিপে ধরতো আমায়, তাইতো পুড়িয়ে দিয়েছি যেনো কোন অস্তিত্ব না থাকে, ভালোবাসা ছিল না, মনে হত কোন এক অভিশাপ, আজ কি হল?

হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়াই.... বিভ্রান্ত, হয়ে নিজেকে অচেনা মনে হয়। কতটা পথ একা হেঁটেছি, পথের শুরুতেই তো অপু হাত ছেড়ে দিয়েছে, সে থেকে একলা পথ চলা, অমিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কবে পথ ফুরিয়ে গেছে টের পাইনি...... আজ এত বছর পর এক টুকরো কাগজের জন্যে বুকের ভিতর এক অচেনা কষ্ট নাড়া দেয়, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজি একটি মাত্র স্মৃতি, একটি কাগজের টুকরোর জন্য, না পেয়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে তাকাই ওই শূন্য আকাশের পানে.... হঠাৎ চমকে উঠি খক্ করে এককাশির শব্দ,

শব্দটি আগেও কোথায় শুনেছি,

এ তো অভির গলা.... ফিরে তাকাই,

অমি... মা একটু বাইরে যাচ্ছি, দরজাটা লাগাও, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি

অমি চলে যাওয়ার পথে, অবিকল অভির মত, সেই মুখ, সেই চোখ সেই হাসি....... এত বড় স্মৃতি অভি

দিয়ে দিয়েছো আমায়, যেনো চাইলেও ভুলতে না পারি তোমায়..... বোকার মত তোমায় খুঁজি এক টুকরো কাগজে....।

রিয়া ও একাকিত্ব জীবনে অস্থির হয়ে উঠে, অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় সে তার বাবার অফিসে বসবে।

সেখানে তার দেখা রিয়ার বাবার বন্ধুর ছেলে রাজিবের সাথে, যে নাকি এক সময় রিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খেতো এবং রিয়াকে হারানোর কষ্টে সে এখন পর্যন্ত বিয়েও করেনি, সে রিয়ার কষ্ট একাকিত্ব জীবনের নি:সঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করে রিয়ার অফিসিয়াল কাজের যেকোন প্রয়োজনে সে রিয়াকে সাহায্য করে...। রিয়াও আস্তে আস্তে রাজীবের সঙ্গ পছন্দ করতে থাকে এবং রাজীবের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

দু’জন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত না নিলেও বেশীর ভাগ সময় এখন দু’জন দু’জনের সাথে কাটায়। অমি যায় বাবার কাছে গিয়ে দেখে বাবা ও তার নতুন সংসার নিয়ে ভালোই আছে।

এ দিকে মায়ের যেনো অমির জন্য সময়ই নেই নানান অজুহাতে অফিসে থাকা রাজীবের সাথে সময় কাটানো বেশি পছন্দ করে।

অমি বসে থাকে সোফায়, রিয়া বাড়ি ফিরে, রিয়া অমিকে জিজ্ঞেস করে খেয়েছো? অমি বলে হুম, রিয়া তারাতারি চলে যেতে থাকে, অমি পিছন থেকে মাকে ডাকে, রিয়া ফিরে তাকায়, অমি রিয়াকে প্রশ্ন করে মা, বাবাকে ছেড়ে ছিলে কেনো মা?

রিয়া হতবম্ভ হয়ে তাকিয়ে রয়.... অমি আবার জিজ্ঞেস করে মা বাবাকে ছেড়েছিলে কেনো?

রিয়া, আস্তে করে বলে তোমার জন্য, তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য।

অমি রিয়াকে বলে, তাহলে মা এখন আমি কই?

আমি কই মা?

কোথায় আমার সুন্দর ভবিষ্যত?

এই আমার সুন্দর ভবিষ্যত?

জীবনের প্রয়োজনে জীবনকে নিয়েছো, বেছে, মাঝে আমি তো রয়েছি সেই পথেরই মাঝে একা দাঁড়িয়ে, যেটুকু প্রয়োজন ছিলো আমার তোমাদের কাছে সে তো মনে হয় শুধু বিচ্ছেদের এক অজুহাতে।

তুমি এখন ব্যস্ত তোমার জীবন নিয়ে, বাবা ব্যস্ত বাবার জীবনে....

তাহলে সেই বিচ্ছেদের কারণ আমি কেনো মা?


এনএম/এমএস