ফকির জাহাঙ্গীর। ছবিঃ সংগৃহীত
ফকির আলমগীর : জন্ম আমার ফরিদপুরে। বাবা হাচেন ফকির ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজসেবক, মানবদরদি এক আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ। তিনি আজীবন হাজি শরীয়তুল্লাহর বংশধর ফরায়েজি আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই ও আট বোন। বড় ভাই ফকির আবদুল কাদির, মেজ ভাই ফকির জলিল ইন্তেকাল করেছেন অনেক আগেই। আর গত ১৭ অক্টোবর আমরা হারালাম আমাদের অভিভাবক, আমাদের সেজ ভাইকে। আমরা যাকে আদর করে দাদা বলে ডাকতাম, সেই প্রিয় মুখ ফকির জাহাঙ্গীর। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, চার কন্যা, এক পুত্র সন্তান এবং অগণিত ভক্ত-শুভানুধ্যায়ী-আত্মীয়-স্বজন।
সেই শৈশব থেকে দেখেছি, বাবা-মা আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে দাদাকে বেশি পছন্দ করতেন; ভালোবাসতেন এবং ভরসা করতেন। বাবা তাকে ছোট বয়সে বিয়ে করিয়ে দেন। তিনি দাদা ও বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সংসারের হাল ধরেছিলেন। তাঁর মতোই মানবসেবার পাশাপাশি তিনটি থানার যত বিচার-সালিশ-বৈঠকে অংশগ্রহণ করে কেবল দায়িত্ব পালন করেননি, প্রশংসিত হয়েছিলেন। সবার কাছে হয়ে উঠেছিলেন আপনজন-বন্ধু-স্বজন। দূর-দূরান্ত থেকে সমস্যা-সংকটে দাদার কাছে মানুষ ছুটে আসত। একাধিকবার তিনি ঐতিহ্যবাহী কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেও কোনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন না। মানবসেবাই ছিল তাঁর ধর্ম। হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর সামাজিক গুণাবলি, আতিথেয়তা, পরোপকার, সততার কথা বলে শেষ করা যাবে না। সে কারণেই ১৮ অক্টোবর তাঁর জানাজায় হাজার-হাজার মানুষ প্রখর রোদের মধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল। তারপর সবুজ বনবীথিকায় আচ্ছাদিত বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
মৃত্যুর আগে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে, স্নেহ-আদর আর ভালোবাসার হাত আমার মাথায় রেখেছিলেন। আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার সন্তানদের সামনে কী যেন বলেছিলেন, যার অর্থ আমি বুঝি। কারণ, আমরা তিন ভাই ছিলাম এক আত্মা, এক সংসার। দাদা বাবার মতোই আমাদের মাথার ছাতা ছিলেন, অভিভাবক ছিলেন, ভরসাস্থল ছিলেন। ঢাকায় আসার আগে বাড়ি পাকা করার কাজ ধরেছিলেন যার সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তবে মসজিদ নির্মাণ, ছেলে সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য আরও উন্নত আবাসন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। আমরা তিন ভাই পরামর্শ করে ঢাকা কিংবা দেশের সব কাজ সম্পন্ন করতাম। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কিংবা পহেলা বৈশাখ, আমার জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকীসহ সব সামাজিক কর্মকাণ্ডে সমস্ত কাজ ফেলে ঢাকায় চলে আসতেন। তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রাণিত করত। '৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হলে তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন। এরপর স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য আমার ভাই আমাকে উৎসাহিত করতেন, আমাকে তাগিদ দিতেন, স্মরণ করিয়ে দিতেন। সর্বক্ষেত্রে তিনি আমার সাফল্য কামনা করতেন।
তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। সবাইকে অতি সহজে আপন করে নিতে পারতেন। আমার সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনিদের তিনি ভীষণ আদর করতেন। বিনিময়ে তিনি কিছু চাননি কোনদিন। আজ অনেক আফসোস হয়, কেন তাকে আমি দেখভাল করতে পারিনি। সারাজীবন ভাইটি আমার কষ্ট করেছে। যখন সুখের নাগাল হলো তখনই আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেল। স্বচক্ষে দেখেছি, দেশের মানুষের আত্মীয়-স্বজনের কান্নার রোল। দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। কাকে রেখে এলাম বাবা-মায়ের কবরের পাশে; চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন এমনই একজন মানুষ যিনি আর কোনো অনুষ্ঠানে ঢাকায় ছুটে আসবেন না। ঈদুল আজহা আসবে, আসবে ঈদুল ফিতর; কেবল আমার দাদা ফিরে আসবে না।
আমরা জানি, নয়ন সমুখে না থাকলেও তুমি নয়নের মাঝে নিয়েছ যে ঠাঁই।
লেখক : গণসংগীতশিল্পী
এমএস/জেইউ