ছবি: সংগৃহীত
মুহম্মিদ জাভেদ হাকিম : সন্ত্রাস আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত। এর ব্যাপকতা এতটাই বেড়েছে যে, সন্ত্রাসীরাই যেন আজ সমাজের দিক নির্দেশক। সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে বেশি ব্যবসায়ীরাও। অথচ নির্বিঘ্ন ব্যবসার বাণিজ্যর প্রধান শর্ত সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ। যেকোন সুষ্ঠু পরিবেশে বিনিয়োগ ও ক্রেতা সাধারণের সমাগম বেশি ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের কারণেই আজ আমরা সন্ত্রাসীদের মুঠোবদ্ধ।
মায়ের গর্ভ হতে কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জম্মায় না। একজন মানুষকে সন্ত্রাসী হতে সহায়তা করে অগ্রজ সন্ত্রাসীর দল। বিপথগামী মানুষ যখন ধীরেধীরে নানান সামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন হতেই তাকে বাধা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু কে দেবে বাধা? অনেকেই ভাবেন, আমি যাব কেন! কারো আবার ইচ্ছে থাকলেও ইজ্জৎ হারানো বা ঝামেলা এড়ানোর কথা ভেবে খোলা চোখেও অন্ধ সেজে থাকে। আর এভাবেই দিন কে দিন সন্ত্রাসের মাত্রা বাড়তে থাকে। একজন ছেঁচড়া সন্ত্রাসীও গডফাদারে পরিণত হতে থাকে। একটি সমাজে টাউট,বাটপার,সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের চাইতে অনেক বেশি ভালো মানুষের সংখ্যা। কিন্তু এরপরেও সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়ায়। একেবারে আইন,বিচার, সালিশ ও প্রশাসন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে থাকে তাদের পদচারণা। অতিষ্ঠ করে তোলে জনজীবন। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ে তাদের অপতৎপরতায়। এসব একদিন-দু’দিনে হয় না। দিনের পর দিন ভদ্রলোকদের নীরবতাও এর জন্য অনেকখানি দায়ি।
সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগির চারপাশে থাকা ভদ্রলোকরা যখন এগিয়ে না আসে, তখন এমনিতেই নির্যাতিতকে চুপসে যেতে হয়। আর সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকা দালাল গোষ্ঠির হীনতৎপরতাও বাড়তে থাকে। এসব কারণে একজন নির্যাতিত ব্যবসায়ী এমনিতেই ভীতু হয়ে যায়। কখনো কখনো ভুক্তভুগী গুটিয়ে যান। অনেক সময় সামাজিক ও ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতারাও ভয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নীরবতা পালন করে থাকে। তাহলে সংগঠন, সমিতি- এগুলো কিসের জন্য? কাদের স্বার্থে গড়ে তোলা হয় নানান সংগঠন-সমিতি? তাহলে কি শক্তের ভক্ত নরমের জম? এর কারণ জানতে চাইলে অনেকেই বলে থাকেন, জানের ভয় আছে না? প্রতিবাদ করলে অপমান-অপদস্থ হয়ে ইজ্জৎ যাবে।
একজন মানুষ দুনিয়াতে আসে একবার। তার মৃত্যুও হবে একবারই। মানুষের বাঁচা-মরা হতে হবে গৌরবের সঙ্গে। গৌরবময় জীবন ও নেতৃত্ব আগামি প্রজন্মের পথ প্রদর্শক। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মেরুদন্ডহীন জীবন লজ্জার কারণ। পবিত্র কোরআনে কোথাও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। সন্ত্রসীদের প্রকারভেদে রয়েছে কঠিন শাস্তি। শুধু কোরআনে বর্ণিত রয়েছে তা-ই না, সন্ত্রাস নির্মূলে বাস্তবায়নে রাসুল [সাঃ] পর্যন্ত তাঁর সাহাবিদের নিয়ে কাজ করেছেন। এর জন্য বহু সাহাবি নির্যাতিত ও হত্যার শিকারও হয়েছিলেন।
সাধ্যমত অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব। অন্যান্য ধর্মেও সন্ত্রাসের প্রশ্রয় নেই। ঠান্ডা মাথায় যেকোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া মানে গোটা সমাজ ও জাতির উপর বিপদ ডেকে আনা। যে বিপদে সে নিজেও একদিন পর্যুদস্তু হয়ে পড়ে। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে করতে গা বাঁচিয়ে চলার বদ অভ্যাসের দরুন একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সামাজ সন্ত্রসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সন্ত্রাসের শিকার অনেক মানুষের উক্তি, কী হবে প্রশাসনকে বা সমিতিকে জানিয়ে? মানুষের এই মনন বিকলাঙ্গতাও সন্ত্রাস বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও যে কোন সামাজিক সংগঠনেও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব এবং দায়িত্ববান কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। আর কথিত ভদ্রলোকেরা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সমাজে,বাজারে, রাষ্ট্রে সন্ত্রাস প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধতাই প্রধান হাতিয়ার। যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রশাসন, সমতি বা সংগঠন গুলোকে জানান। দেখবেন, তারাও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে।
সাম্প্রতিক সময়ের একটি আলোচিত ঘটনা উল্লেখ করে আজকের লেখার ইতি টানব। গত ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের বৃহৎ পাইকারী থান কাপড়ের বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুরের আহসান মঞ্জিল মিউনিসিপাল সুপার মার্কেটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ. হাকিম ট্রেডার্স-এর মালিকের উপর চাঁদার দাবিতে স্থানীয় সন্ত্রাসী মুন্না তার দলবল নিয়ে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। এই হামলার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ মিছিল করেন। মার্কেট দোকান মালিক সমিতি, ইসলামপুর ব্যবসায়ী সমতি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মার্কেট ফেডারেশ সহ আশপাশের সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসে। হয় স্মরণকালের বৃহত্তম প্রতিবাদ সমাবেশ। এরপরেও যখন সন্ত্রাসী মুন্না গং মহড়া দিতে থাকে, তখন বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ী নেতারা প্রশাসনকে জানায়। পুলিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করে।
সব কিছুর মূলেই হল ঐক্যবদ্ধতা। সন্ত্রাস নির্মুলে চাই ঐকান্তিক ইচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসীদের চাইতে শান্তিপ্রিয় মানুষের সংখ্যাই বেশি। আর তারা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন যত বড় সন্ত্রাসীই হোক, সে লেজ গুটাতে বাধ্য।