ফাইল ছবি
ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন : গ্লোব বায়োটেকে কর্মরত বিজ্ঞানীদের ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকায় করোনা প্রাদুর্ভাবের পর আমরা কভিড-১৯ শনাক্তকরণ কিট, টিকা ও ওষুধ আবিষ্কার সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করি। ২০২০ সালের ২ জুলাই কভিড-১৯-এর টিকা উদ্ভাবনের ঘোষণা দিই। আমাদের mRNA vaccine-কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। টিকাটির বঙ্গভ্যাক্স নামকরণ করেছি, যা একই সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের নামকে প্রতিনিধিত্ব করে। করোনাভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করেছি, এনসিবিআই ভাইরাস ডাটাবেইসে প্রাপ্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কভিড-১৯-এর সব সিকোয়েন্স বায়োইনফরমেটিকস টুলসের মাধ্যমে বিশদ পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করেছি আমাদের টিকার লক্ষ্য। টার্গেটের সম্পূর্ণ কোডিং সিকোয়েন্স এনসিবিআই ডাটাবেইসে প্রকাশিত হয়েছে (accession number: MT676411)। এনিম্যাল সেন্টারে টিকার প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেছি, ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ো-আর্কাইভ (bioRxiv)-এ (https://doi.org/10.1101/2020.09.29.319061)। নিবন্ধটি এরই মধ্যে আট হাজার ৫০০ বিজ্ঞানী পর্যালোচনা করে খুবই কার্যকর ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই নিবন্ধন এরই মধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাবলিশার্স এলসেভিইয়ারের ভ্যাকসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (DOI: https://doi.org/10.1016/ j.vaccine.2021.05.035)
টিকাটির ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রটোকলসহ আবেদন করি। ৯ ফেব্রুয়ারি বিএমআরসির ইথিক্যাল কমিটি প্রটোকল পর্যালোচনা করে শতাধিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিলে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএমআরসিতে জমা দিই। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর গত ২২ জুন বিএমআরসি জানায়, আগে বানর অথবা শিম্পাঞ্জিতে টিকাটির ট্রায়াল করতে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বলছে, mRNA টিকার জন্য বানরের ওপর পরীক্ষার দরকার নেই। কিন্তু বিএমআরসি বলছে, করতে হবে। ৩০ জুন বিএমআরসি থেকে আরো অর্ধশতাধিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণসহ চিঠি দেয়।
বানরের ওপর ট্রায়ালের জন্য ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জিটুজি পদ্ধতিতে আবেদন করতে বলে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেও আশানুরূপ ফল পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুসরণ করে বন বিভাগের অনুমোদন নিয়ে বানর সংগ্রহ করে ১ আগস্ট বানরের ওপর ট্রায়াল শুরু করি, শেষ হয় ২১ আগস্ট।
এসংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং একই সঙ্গে বিএমআরসির তৃতীয় ও সর্বশেষ চিঠির সব প্রশ্নের জবাবও গত ১ নভেম্বর বিএমআরসিতে জমা দিই। অবশেষে ২১ নভেম্বর বিএমআরসির ন্যাশনাল রিসার্চ এথিকস কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৩ নভেম্বর নৈতিক অনুমোদনের চিঠি হাতে পাই। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আমরা নৈতিক অনুমোদনের চিঠিসহ গত ২৫ নভেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করি। বানর আর মানুষের মধ্যে জিনগত বেশ মিল থাকায় এবং বানরের পরীক্ষায় বঙ্গভ্যাক্স সম্পূর্ণ নিরাপদ ও শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় আমরা খুবই আশাবাদী যে বঙ্গভ্যাক্স মানবদেহেও অনুরূপভাবে কাজ করবে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বে অতি সংক্রমণশীল ডেল্টাসহ করোনাভাইরাসের ১১টি ভেরিয়েন্ট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় ছিল। আমরা সব কটির সিকোয়েন্স অ্যানালিসিস করে আমাদের ভ্যাকসিনের সিকোয়েন্স মিলিয়ে দেখেছি, প্রতিটি ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রেই বঙ্গভ্যাক্স কার্যকর। প্রাথমিক ফলাফলে আমাদের ভ্যাকসিনটি বানরে নিরাপদ ও কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনেটেড বানরে করোনাভাইরাসের ডেল্টাসহ অন্যান্য ভেরিয়েন্ট প্রয়োগ করে চ্যালেঞ্জ স্টাডি করেছি। আমাদের ভ্যাকসিনে বানরের দেহে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সেই অ্যান্টিবডি সাত দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসকে নিউট্রালাইজ করতে পেরেছে। তাই উন্নত বিশ্ব করোনা মোকাবেলায় যে নতুন ভ্যাকসিনের কথা বলছে, আমরা মনে করি, সেই নতুন ভ্যাকসিনটি হতে পারে বঙ্গভ্যাক্স। যেসব দেশে এরই মধ্যে বিভিন্ন টিকা দেওয়া হয়েছে, সেসব দেশে বুস্টার ডোজ হিসেবেও বঙ্গভ্যাক্স দেওয়া যাবে।
আমাদের টিকাটির একটি ডোজেই কার্যকর অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। আশা করছি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও অনুরূপ ফল পাওয়া যাবে। এটি প্লাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক মাস এবং মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। সিনথেটিক্যালি তৈরি হওয়ায় এটি ভাইরাসমুক্ত এবং শতভাগ হালাল। যদি দ্রুততম সময়ে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশবাসীর সেবায় বঙ্গভ্যাক্সকে উৎসর্গ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বদরবারে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক, কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি, গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড।
এএইচ