ফাইল ছবি
পি আর প্ল্যাসিড
ঢাকায় অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কত সালে প্রথম গিয়েছি এখন সেটা আর মনে করতে পারছি না। তবে একসময় মেলায় যেতাম ঘুরতে এবং বই কিনতে। বই কিনে লেখকদের অটোগ্রাফ নেবার জন্য স্টলের সামনে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতাম। কখনো কখনো স্টলের সামনে ধাক্কাধাক্কি করে তবেই লেখকের অটোগ্রাফ নিয়েছি। তবে হিসেব করলে বেশি বই কিনেছি আমি ইমদাদুল হক মিলনের। এরপর হুমায়ূন আহমেদ এর বই। তবে এটাও ঠিক যে সে সময় একা কখনো মেলায় যাওয়া হয়নি। প্রতিবারই যেতাম সাথে কাউকে নিয়ে। আর কেনা সেই বই তাকেই দিয়ে দিতাম উপহার হিসেবে।
দেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের কাতারে থেকে বই মেলায় অংশ নেবার আগেই চলে আসি জাপান। তাও ১৯৯১ সালের কথা। এরপর অনেকগুলো বছর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি। জাপানে প্রবাস জীবনচলাকালেই সখ জাগলো মনে লেখক হবার। দেশে ছাত্র অবস্থায় লেখালেখি করার বদৌলতেই এমন শখ জেগে উঠা। কিন্তু জাপানের মতো যান্ত্রিক দেশ যেখানে দিন রাত মানুষ কাজ করে চলে, কাজ ছাড়া অন্য আর কিছু বোঝে না সেই দেশে এসে আমি নিজেও হয়ে উঠেছিলাম এক ধরনের রোবট।
যে সময় আমি জাপান এসেছি তখন জাপানের উর্ধ্বগতি অর্থনীতির কারণে শ্রমিকের অপ্রতুলতার কারণে দিনরাত ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে হয়েছে। এরপরেও বইমেলা উপলক্ষে গল্প লেখার ইচ্ছে ছিল প্রচণ্ড। রাতে না ঘুমিয়ে লেখা চালিয়েছি। এমনকি ফ্যাক্টরিতে কাজের সময় দুপুরে খাবার যে সময় পেয়েছি সে সময় বিশ্রাম না করে লেখা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। লেখা শেষ করে দেশে পাঠিয়ে দিলাম স্বপ্ন সফলতার জন্য।
সেসময় আজকের দিনের মতো যোগাযোগের এতো ভালো ব্যবস্থা ছিল না। তারপরেও বড় সেই লেখা ডাকযোগে বাংলাবাজারে এক প্রকাশকের ঠিকানায় পাঠালাম। প্রকাশক আমার সেই লেখা পড়ে নিজ দায়িত্বে কম্পোজ করিয়ে এডিট করিয়ে আবার ডাকযোগে পাঠালেন আমার কাছে। সেটা আমি পড়ে দেখে যেখানে যেখানে এডিট করা দরকার সেখানে এডিট করে আবার পাঠালাম। এভাবে কয়েকবার এডিট করে ডাকযোগে লেখা পাঠানোর পর চূড়ান্ত করা হয়েছিল আমার তখন প্রথম প্রকাশিতব্য গ্রন্থ।
পরে ১৯৯৭ সালের একুশে গ্রন্থমেলাতে প্রকাশিত হলো আমার প্রথম গ্রন্থ ‘অনুশোচনা’। এটাকে গল্প বলবো নাকি উপন্যাস বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এর সঠিক উত্তর দিতে অভিজ্ঞদের কয়েকজনের সাথে আলোচনা করলাম। পড়তে দিলাম লেখাটি। তারাই বললেন, লেখা পড়ে বলা যায় এটা একটি উপন্যাস। সেই থেকে বলি আমার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ ‘অনুশোচনা’।
সে বছরই একুশে গ্রন্থমেলায় গ্রাম থেকে মা ঢাকা এসে গিয়েছিলেন আমার বই কিনে আনতে। মা আমার ‘অনুশোচনা’ বই কিনে নিয়েও গেলেন একুশের গ্রন্থমেলা থেকে। এরপর দুই সপ্তাহ পর মা-র লেখা চিঠি পেলাম। চিঠিতে মা লিখেছিলেন, মেলায় গিয়ে আমার বই দেখে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন আনন্দে। আরো বেশি আনন্দের কারণ ছিল মা’র, মাইকে আমার নাম ঘোষণা করতে শুনে। মায়ের সেদিনের চিঠি পড়ে আমি আনন্দে কেঁদেছিলাম।
এরপর আবার মনে হয় ২০০০ সালের পর থেকে আবার বই মেলায় যেতে শুরু করি। পুরোদমে সাহিত্যিক হতে না পারলেও লেখক সাংবাদিক পরিচয় নিয়ে যাতায়াত শুরু করি সর্বত্র। একসময় বই প্রকাশের স্বাদ নিতে বই মেলায় বিভিন্ন প্রকাশকের স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এরপর একদম স্টলের ভিতরে। লেখক হিসেবে ভক্ত পাঠকদের সাথে ফেসবুকের বদৌলতে দেখা হয় একুশে গ্রন্থমেলায়। কতো বড় পাগল না হলে জাপানে কাজ বন্ধ রেখে টাকা খরচ করে বই মেলায় অংশ গ্রহণ করা। দেশে গেলেও যে খরচ আমার কম হয় না। এভাবেই চলতে থাকে আমার লেখালেখি আর বই মেলায় অংশ গ্রহণ।
বেশ কয়েকবার বইমেলায় অংশ নিতে পুরো মাস থেকেছি দেশে। কিন্তু প্রকাশকদের মধ্যে যাদের সাথে এপর্যন্ত আমি নিজে কাজ করেছি তাদের সাথে ভালো কোন অভিজ্ঞতা থলিতে জমা হয়নি। তাই ২০২০ এর শেষ দিকে এসে প্রকাশনা শুরু করি। এর আগেও দুবার দেশে বিবেক নামে প্রকাশনী শুরু করেছিলাম কিন্তু নিজে উপস্থিত না থাকলে যা হয় তাই হলো। তাই সে দুবার প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করি।
এবার অন্যবারের তুলনায় একটু ভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করলে মনে হলো দেশে আমার একুশে গ্রন্থ মেলায় অংশ নেয়া জরুরি, তাই মেলার আগে আবেদন করলাম স্টলের জন্য। একদম শেষ সময় জানতে পারি যে এবার মেলায় বিবেক এর স্টল দেবার সুযোগ পেয়েছে। তাই দ্রুত কাজে হাত দিয়ে এক রাতের মধ্যে সকল কাজ সম্পন্ন করে মেলার শুরুর দিনে লোক নিয়োগ দিয়ে মেলা শুরু করার ঘোষণা দেই ফেসবুকে।
ভেবেছিলাম মেলার শুরু থেকে দেশে যাবো, গিয়ে মেলায় উপস্থিত থাকবো। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারিনি। এবছর একুশে গ্রন্থ মেলা ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু করে মার্চ মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চালিয়েছে। এই ১৭ মার্চ ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। আমার ধারণা এখন থেকে মেলার সময়সূচি এমনটাই হবে। সে যা-ই হোক আমি সেটা নিয়ে কথা বলছি না। বলা হচ্ছে প্রথম বই প্রকাশকালে আমি যেমন গ্রন্থমেলায় অনুপস্থিত ছিলাম তেমনই প্রকাশক হিসেবে মেলায় প্রথমবারের মতো স্টল নিয়ে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এ যে কতো বড় যন্ত্রণা সেটা আমি ছাড়া আর কাউকে বোঝানো যাবে না। তারপরেও মেলা পুরো একমাস চলেছে যা শুরুর দিকে ধারণা করা যায়নি।
করোনাকালে মেলা কর্তৃপক্ষ সুন্দর সুষ্ঠুভাবে মেলা সম্পন্ন করায় ধন্যবাদ জানাই। প্রবাসে বসে মেলার স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আর যে কোনো উপায়ও নেই।
লেখক : জাপান প্রবাসী সাংবাদিক।