ছবিঃ গ্লোবাল টিভি
মাতৃভাষা ও আমাদের আগামী প্রজন্ম
মোস্তাফিজুর রহমান রেমন্ড: “জানেন দাদা? আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না” - কবি ভবানী প্রসাদ মজুমদারের লেখা কবিতার এই চরণ যেন আজকাল অধিকাংশ অভিভাবকের কথাই তুলে ধরেছে। আজকাল যার সন্তান বাংলা যত কম জানে সে যেন তত বেশি উঁচু তলার লোক। অন্তত তাদের আচরণে তাই মনে হয়। আসলেই কি তাই? আমি একজন শিক্ষক হিসাবে এই বিষয়টিকে যেভাবে দেখি তাই তুলে ধরতে চাই।
একটি শিশু যখন মাতৃভাষাকে আত্মস্থ করতে পারে সে সবকিছুতেই এগিয়ে যেতে পারে। মাতৃভাষা আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই সংস্কৃতিকে না জেনে যেমন কেউ দেশকে জানতে পারে না, তেমনি দেশকে না জেনে কেউ দেশকে ভালোবাসতে পারেনা। আর যার মধ্যে দেশপ্রেম নেই সে আর যাই হোক ভালো মানুষ হতে পারে না। অস্বীকার করছিনা যে, বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অনেক। তাই আজকাল যারা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাচ্ছেন আমি তাদের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা ইংরেজি জানাকে শুধু জাতে উঠা মনে করছেন তাদের সাথে আমার দ্বিমত রয়েছে। তারা মনে করছেন ইংরেজি জানলেই হলো। কিন্তু একবার ভাবুন যে সন্তানের কান্না শুরু হয় ‘মা’ দিয়ে তার আবেগ কোন ভাষায় প্রতিষ্ঠিত? ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়। তাই আমরা আমাদের চিন্তাটাও প্রথমে মাতৃভাষাতেই করি। তারপর হয়তো এটাকে ইংরেজিতে প্রকাশ করি। কথায় আছে মানুষ তার চিন্তার সমান বড়। তাই যে বাংলা ভাষায় যত দক্ষ সে ইংরেজিতে তত বেশি উন্নত। তাই মনে রাখবেন শিশুদেরকে সঠিকভাবে বাংলা ভাষা শেখালে কখনোই সে ইংরেজিতে দুর্বল হয়না বরং তার চিন্তাটা উন্নত হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা কিন্তু ইংরেজি ভাষায় বা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা কিন্তু বাংলাটাকে বুকে ধারণ করে লিখে গেছেন বহু বিখ্যাত গ্রন্থ, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসীম উদ্দীন প্রমুখ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এবার আসছি পারিবারিক সম্পর্কের কথায়। যারা বাংলাকে পাশ কাটিয়ে শুধু ইংরেজিতে ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিয়েছেন তারা কি জানে এ দেশের আবেগ অনুভূতি সম্পর্কে? তাদের কাছে কি আসে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ? তাদের মধ্যে কি জাগ্রত হয় মানবতার কোমল দিকগুলো? মোটেই না। অথচ এই অধঃপতন আমাদের নিজেদেরই তৈরি। আমি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য কলেজে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াই। আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন মানুষ অধ্যক্ষ নিশাত পারভীন হক। তিনি সারাজীবন ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন বাংলায় কথা বলেন আমি বিমুগ্ধ হয়ে শুনি আর ভাবি রবীন্দ্রনাথের সেই কথা -আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন। আমি অবাক হই বাংলা ভাষা নিয়ে তার গভীর ভালোবাসার কথা জেনে। সময়ের প্রয়োজনে বা আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে আদরের নাতনি আমায়া তানিশা হককে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেও পারিবারিক শিক্ষায় তার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন বাংলাভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। তাই সে পশ্চীমা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলেও তার মধ্যে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষা ও দেশের সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর টান। আমি অবাক হয়েছি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েও বাংলা ভাষাকে নিয়ে মাত্র গ্রেড- ৭ এ অধ্যয়নরত এই শিশু কত চমৎকারভাবে লিখতে পারে। আমার আলোচনার সার্থক রূপায়ণ যেন তার নিজের লেখা একটি অনুচ্ছেদ যা নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো:
বাংলা এবং আমি
আমার মাতৃভাষার সাথে আমার সম্পর্ক খুবই জটিল। এটি প্রেমময় মধ্যবিত্ত বাবা-মা এবং তাদের বিচ্ছিন্ন কিশোরী কন্যার মধ্যে সম্পর্কের মতো। তাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা "ব্যবধান" বা "সেতু" রয়েছে এবং তাই এটি দূরত্ব অনুভব করে।
গভীরভাবে আমি আমার ভাষাকে ভালবাসি এবং আমি আমার সংস্কৃতিকে ভালবাসি। কিন্তু আমার লালন-পালনের কারণে আমার সমস্ত আগ্রহ এবং পছন্দ এবং আমার সম্পূর্ণ মানসিকতা পশ্চিমা, যার ফলে আমি আমার সংস্কৃতি থেকে দূরে বোধ করি। এটি আমার পরিবারের জন্যও একই, এবং আমি মনে করি যে এটি এখানে প্রযোজ্য কারণ আমি আমার পরিবারের সাথে বাংলা ভাষাকে আন্তঃসম্পর্কিত করি। আমি আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি এবং ইংরেজিতেই নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচিতি হই। আমি ইংরেজি গান শুনি, এবং আমি যে মিডিয়া দেখি তাও ইংরেজিতে। এমনকি আমি আমার ছোট বোনের সাথে ইংরেজিতে কথা বলি, কারণ এটিই তার (এবং আংশিকভাবে আমার) কাছে স্বাভাবিকভাবেই আসে। আমার বাবা-মা এবং ঘনিষ্ঠ পরিবারই কমবেশি একমাত্র মানুষ যারা আমার সাথে বাংলায় কথা বলেন, এবং যেহেতু তারা এমন একটি প্রজন্মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে ইংরেজির ব্যবহার সীমিত ছিল, তাই আমি তাদের সাথে আমার মাতৃভাষা যুক্ত করি। তাই আমার সংস্কৃতি এবং ভাষার কাছাকাছি বেড়ে ওঠা মানে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়া, এবং আমি এর জন্য খুব বেশি উপযুক্ত নই, কারণ আমি সবসময়ই আমার পরিবারের সদস্যদের থেকে আবেগগতভাবে দূরে ছিলাম। কখনও কখনও আমি আমার ভাষা এবং ইতিহাসের কাছাকাছি না থাকার জন্য দোষী বোধ করি, বিশেষ করে যেহেতু এটি আমার (জাতীয়) পরিচয়ের অংশ। এটি আমাকে অপরাধী এবং কিছুটা বিব্রত বোধ করায় যে আমার বাংলাভাষ আমার ইংরেজির মতো উন্নত নয়। যদিও আমি এই ধরনের বিষয়ে খুব একটা নিবেদিত নই, আমি আমার পরিবারের সাথে এবং আমার ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার উষ্ণতা এবং ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতে চাই, বিশেষ করে যখন তাদেরকে খুবই আন্তরিক এবং কোমল বলে মনে হয়। আমি প্রধানত আমার পারিবারিক এবং সাংস্কৃতিক পটভূমির সাথে একটি সুস্থ কিন্তু মুক্ত সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। যখনই আমি বাড়তি বাংলা বলি, যদিও তা “জি” (“হ্যাঁ”) বা “কী” (“কী?”)-এর মতো গৌণ কিছু হলেও, আমি আমার মাতৃভূমির একধাপ কাছাকাছি হতে পেরে গর্ব ও উষ্ণতা অনুভব করি। আমি আগের চেয়ে বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বেশি অনুভব করি।
একটি ভাষা হিসাবে বাংলা আমাদের ইতিহাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এবং এটি আমাদের ঐতিহ্যের কাছাকাছি হওয়ার একটি প্রবেশদ্বার।
-আমায়া তানিশা হক, সপ্তম শ্রেণী সানবিমস স্কুল।
বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ আর আবেগমাখা এই সুন্দর অভিপ্রায় প্রমাণ করে যে, পারিবারিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় একটি শিশুর মধ্যে গড়ে উঠতে পারে ভাষা, সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আসুন সবাই মিলে তৈরি করি একটি সুন্দর আলোকিত আগামী প্রজন্ম যেটি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন আমায়া তানিশা হকের পরিবার বিশেষ করে তার দাদি অধ্যক্ষ নিশাত পারভীন হক।
*মোস্তাফিজুর রহমান রেমন্ড: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।
এএইচ