ছবি : সংগৃহীত
ড. আতাউর রহমান
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন ৮৬ লাখ মানুষ। এর মাঝে কিডনি আর ক্যান্সারের দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনকারীদের সংখ্যা বেশি। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুসারে, দেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বছরে ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তবে এ প্রতিবেদনগুলোতে আসা বড় সংখ্যাগুলো বাস্তবে প্রতিটি পরিবারের যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, তা তুলে ধরতে পারে না।
পাবমেড ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ৬০ বছরের কম বয়সী ৮,১৩,৮০৭ জন মারা যায়। এদের অকালমৃত্যুর ফলে যে কর্মঘণ্টার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়, তার মূল্য ৯৭.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রতি জনে ১৬, ৯৮৭ ইউএস ডলার ধরে)। অর্থাৎ এই অর্থ জিডিপিতে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল।
'বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮'-এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি চার জনের একজন উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভোগেন। (বিবিসি বাংলা, ১৬ অক্টোবর ২০২০)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২০ সালে দেশে হৃদরোগে মারা গেছেন ১,০৮,৫২৮ জন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন!
হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ অসংক্রামক রোগগুলোতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যে আমাদের দেশে আশংকাজনক হারে বাড়ছে, তা বোঝার জন্যে আসলে আলাদা জরিপের প্রয়োজন হয় না। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হাসপাতাল আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোই এর প্রমাণ। তবে এসব রোগের মূল কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, অসুস্থ জীবনাচার।
২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দেশে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার! এই মাত্রাতিরিক্ত গ্যাসের ওষুধ থেকে আমরা বুঝতে পারি, পুষ্টিবিজ্ঞানসম্মত খাবার এবং সুস্থ জীবনাচার অনুসরণে আমরা কতটা পিছিয়ে পড়েছি।
অসংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে সুস্থ জীবনাচারের কোনো বিকল্প নেই। সুস্থ জীবনাচার অনুসরণকে সহজ করতেই প্রয়োজন মেডিটেশন চর্চা। কারণ মেডিটেশন একদিকে যেমন দৈনন্দিন স্ট্রেস দূর করে, তেমনি ব্যক্তির সহজাত সুস্থ থাকার ক্ষমতাকে বাড়ায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে খ্যাতনামা প্লস ওয়ান (PLOS ONE) জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে উঠে আসে চমকপ্রদ তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের বেনসন-হেনরি ইনস্টিটিউট ফর মাইন্ড বডি মেডিসিন-এর গবেষকরা দুই দল আমেরিকানের ওপর দীর্ঘ আট বছর (২০০৬-২০১৪) জরিপ চালান। প্রথম দলের চার হাজার আমেরিকান নিয়মিত মেডিটেশন করেন। দ্বিতীয় দলে ছিলেন ১৩ হাজার গড়পড়তা আমেরিকান, যারা অসুস্থ হলে শুধু ওষুধ সেবন করেন। দেখা গেছে, প্রথম দল দ্বিতীয় দলের চেয়ে অসুস্থতার কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন ৪৩ শতাংশ কম। অর্থাৎ মেডিটেশন চর্চায় সুস্থ থাকার হার বাড়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
গবেষকরা তাদের রিপোর্টে লিখেছেন, নিয়মিত মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমে একজন আমেরিকান চিকিৎসা বাবদ (ডাক্তার, হাসপাতাল ও ওষুধের খরচ) বছরে ২৫ হাজার ডলার পর্যন্ত (প্রায় ২১ লাখ টাকা) বাঁচাতে পারেন। (হাফিংটন পোস্ট, ২৮ অক্টোবর ২০১৫)
বিশ্বজুড়ে এই যখন অবস্থা, মেডিটেশন চর্চার ওপর ভ্যাট আরোপ নয়, বরং মেডিটেশন চর্চা হতে পারে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে অসংক্রামক রোগব্যাধি মোকাবেলার প্রধান হাতিয়ার। কারণ মেডিটেশন চর্চার জন্যে বাড়তি কোনো খরচের প্রয়োজন হয় না।
একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যারা মেডিটেশন চর্চা করেন, তারা সুস্থ জীবনাচার অনুসরণে আগ্রহী হন, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলে অসংক্রামক ব্যাধির নির্মম শিকার হওয়া থেকে তারা বাঁচতে পারেন। একজন গড়পড়তা মানুষ যে সময়ে চারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, মেডিটেশন চর্চাকারীরা সে সময়ে একবার চিকিৎসকের কাছে যান। ফলে তাদের চিকিৎসা ব্যয় লাগে অন্যদের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ গবেষণার আহ্বান হচ্ছে, মেডিটেশন করুন, তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ফেলুন।
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার নীতিমালায় ডাক্তারদের রোগীকে মেডিটেশন চর্চার পরামর্শ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অথচ চলতি বছর বাজেটে মেডিটেশনের উপর ভ্যাট ধার্য্যের প্রস্তাব করা হয়েছে- যা অযৌক্তিক। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এটি বন্ধ করে বরং হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসকদের সরকারি প্রণোদনায় মেডিটেশনের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং রোগীদের জন্যে মেডিটেশন থেরাপি চালু হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে সঠিক বিনিয়োগ।