ঢাকা, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ | ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

গৌরব, আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাসের পদ্মা সেতু

গৌরব, আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাসের পদ্মা সেতু

ফাইল ছবি

সাজ্জাদ হোসেন চিশতী 

 

খুলে গেল স্বপ্নের সেতুর দুয়ার। দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের মনে বইছে আনন্দের জোয়ার। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতির এ যেন আরেক বিজয়! ১৯৭১ সালে টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধরে পর যখন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটি বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা পায় তখন বাঙালি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। সেই আনন্দে মিশে ছিল গৌরব, সন্মান এবং সব হারিয়ে নতুন করে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন। মানুষের মুখে মুখে ছিল তখন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। সেই বিজয়ের অর্ধশত বছর পর পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশবাসী আরেকটি বিজয় পেল। এই বিজয়েও মিশে আছে গৌরব, আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস।

বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে ভাবতেই মনে পুলক জাগে! তবে আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু নিয়ে যতটা সাফল্য আমরা উপলব্ধি করছি তা সহজ ছিল না। প্রকল্পের শুরুতেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে থমকে যায় এই স্বপ্নের সেতু নির্মাণের কাজ। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর। মনে পড়ে সেই দিনের কথা- যেদিন একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল- ‘পদ্মাসেতু হচ্ছে না’। 

২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের হলরুমে ছাত্রদলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়া তালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। শুধু তাই নয়, ‘পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করায় পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবার দায়ী। আমরা ক্ষমতায় এলে একটা নয়, দুটি পদ্মা সেতু বানাবো (দৈনিক মানবজমিন, ৩০ জুন ২০১২)। এ ধরনের কথাও খালেদা জিয়া বলেছেন। তার সঙ্গে তখন সুর মিলিয়ে বলার লোকের অভাব ছিল না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু বানানোর কোনও ইচ্ছা সরকারের ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল লুটপাট। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কল্পনা বিলাস বাদ দিন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুলাই, ২০১২)।

বিশ্বব্যাংক যখন ২০১২ সালের ২৯ জুন নানা ধরনের বায়বীয় অজুহাতে পদ্মা সেতুতে প্রত্যাশিত ঋণ বাতিল করে, একই বছর ৮ জুলাই সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। তাঁর এই ঘোষণাতে চারদিকে বেশ হাস্যরোল সৃষ্টি হয়েছিল।  এ সব  হাস্যরোল তোয়াক্কা না করেই শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছিলেন। সরকার সেতু প্রকল্পের পরামর্শকের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকেও।

সেই সময়ে কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের চাপে সেতু বিভাগের সচিবসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া। যদিও পরে সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কানাডার আদালতে হওয়া মামলায় প্রমাণিত হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সেতু সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়াসহ বাকি অভিযুক্তরা নির্দোষ প্রমাণিত হন। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যে অভিযোগ তোলা হয় সেটিকে ‘মিথ্যা’ আখ্যা দেয় কানাডার আদালত।

মূল সেতু নির্মাণ এবং নদী শাসনের কাজ শুরুর পর থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে। কখনো পদ্মার ভাঙন, আবার কখনো কারিগরি জটিলতায় কাজ আটকে গেছে। মডিফাই করতে হয়েছে নকশায়। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি। ২০১৪ সালের নভেম্বরে কাজ শুরুর পরের বছরেই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালের দিকে স্রোতের কারণে মাওয়ায় নদীর তলদেশে গভীর খাদ তৈরি হয়। এ ছাড়া মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ভাঙন দেখা দেয়। ফলে নদীশাসনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ওই বছর ৩১ জুলাই মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন এরিয়ার কিছু অংশে ভাঙন দেখা দেয়। ওইদিন কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে থাকা অনেক মালামাল নদীতে বিলীন হয়ে যায়। 

২০১৭ সালে সেতুর খুঁটি বসানোর সময় ডিজাইনে থাকা ২২টি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। শুরুতে প্রতিটি পিয়ারের নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর কারণে খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে ঐ বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। এতে বাড়তি সময় লাগে এক বছর। এ কারণে ওই সময় কাজের কিছুটা গতি হারায়।

কত ষড়যন্ত্র, কত মিথ্যাচার! কোনো কিছুই দমাতে পারেনি শেখ হাসিনাকে। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র আর বিশ্বব্যাংক সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর যে সেতু কল্পনায় ছিল না, সেই পদ্মা সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কোনো ষড়যন্ত্রই পদ্মা সেতুর পথ রোধ করতে পারেনি। নিন্দুক আর ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাই দিয়ে ২৫ জুন ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু দেশের পিছিয়ে পড়া ২১ জেলাকে জাগিয়ে তুলতে উম্মুক্ত হলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক মিড়িয়াগুলোতে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন শেখ হাসিনা। 

মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। মানুষ যখন পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার কথা কল্পনাও করেনি। যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে আশা জাগিয়েছে মুক্তির, স্বাধীনতার। তখনও রাজাকার বাহিনী এ নিয়ে কটূক্তি করেছে, ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে দমাতে চেয়েছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা দিয়ে এ জাতিকে এক কাতারে এনে পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। ঠিক বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনা যেন বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু যেমন যে কোনো সিদ্ধান্তে পিছ পা হতেন না, তেমনি শেখ হাসিনাও। তার প্রমাণ এই পদ্মা সেতু। 

শেখ হাসিনা আমাদের এমন এক সেতু উপহার দিয়েছেন যে সেতু  বিশ্ব রেকর্ডও করেছে। প্রথম বিশ্ব রেকর্ডটি হলো- মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো। পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো সেতুতে পাইল এত গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি। দ্বিতীয় রেকর্ড হলো, ভূমিকম্পের বিয়ারিং-সংক্রান্ত। এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। এর পরের বিশ্ব রেকর্ড হলো, পিলার এবং স্প্যানের মাঝে যে বেয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বেয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে এমন বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে। অন্য রেকর্ডটি হলো নদী শাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদী শাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হলো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ। গার্মেন্টস শিল্পসহ নানা কারণে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশের সেই অপবাদ অনেক আগেই ঘুঁচে গেছে। বিশ্ব আজ চিনেছে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ আছে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে অনেক উন্নয়নশীল দেশও তার নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় পিছিয়ে পড়েছে। 

শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন পদ্মা সেতু বাঙালিকে  দাবিয়ে না রাখতে পারার প্রতীক। ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাতে লাভ নেই। মানুষ এখন বুঝে গেছে শেখ হাসিনা শুধু মুখে বলেন না। কাজে প্রমাণ দেন। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী