ছবি: গ্লোবাল টিভি
আফরিন ইনায়া: কথা ছিলো, হাতির ঝিলে গিয়ে বিকালবেলা একটু ঘুরে হালকা কিছু খেয়ে বাসায় চলে আসবো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম কোনো বৃষ্টি নেই। রিক্সাকশায় ওঠার সাথে সাথেই শুরু হলো বৃষ্টি। আমরা ছিলাম দুইটা ছোট বাচ্চাসহ মোট সাতজন মানুষ। এই গুঁড়ি বৃষ্টিতেও আমরা পৌঁছালাম হাতির ঝিলে। সেইখান থেকে পরের জার্নি ছিলো নৌপথে বোটে করে রামপুরায়। উদ্দেশ্য ছিলো ছোট বাচ্চাগুলোকে একটু সময়ের জন্য আনন্দ দেয়া। এর মধ্যে হালকা করে বৃষ্টি হচ্ছিল।
বোট থেকে নেমে একটা ছোট হোটেলে আমরা সবাই নেহারী আর রুটি খেতে খেতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি! ঐখানে সময় গেল প্রায় এক ঘন্টা! এর মধ্যেই বাচ্চারা অতিষ্ঠ বাসার যাওয়ার জন্য। বৃষ্টির তো থামার নাম নেই। এর মধ্যে পাচ্ছি না কোনো সিএনজি! না বাস, না রিকশা, না গাড়ি! কী এক পরিস্থিতিতে ছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না। এর মধ্যে রাস্তায় শত শত মানুষ। আমাদের মতোই করুণ অবস্থা প্রায় সবারই। যাই হোক, পাক্কা এক দেড় ঘন্টা অপেক্ষার পরে একটা সিএনজি পাওয়া যায় এবং আকাশ চুম্বি ভাড়া দাম চেয়ে বসে! আমরা সাতপাঁচ না ভেবে সাতজন মানুষ কিভাবে চড়ে বসেছিলাম ভেতরে, তা আর না বলি!
এর পরে বাসার কাছাকাছি এসেও প্রায় তিন ঘন্টা পানিবন্দি অবস্থায় আছি! বাসায় ঢোকার গেইট বন্ধ। পানিতে ডুবে গেছে পুরো এলাকা! চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সামনে-পেছনে আটকে আছে শত শত রিকশা, স্কুটার, গাড়ি। কখন ঘরে ফিরতে পারব, জানি না। কোনো ভাবেই বাসায় যাওয়া যাচ্ছে না। দুই গেইটে কোনোভাবেই পানির জন্য যাওয়া যাবে না। কিন্তু চেষ্টা করলে পেছনের পকেট গেইট দিয়ে পানিতে এক প্রকার সাঁতার কাটার মতো করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধায় দারোয়ান! সে কিছুতেই ভেতর থেকে গেইট খুলতে রাজি হয় না,তার একটাই কথা, সিঁড়িতে টাইলস বসিয়েছে সকালে, এখন নাকি পা ফেলা যাবে না। আমরা পুরো গলির পচা পানিতে সাঁতরে তীরে এসে তরী যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বাসায় ঢুকতে না পেরে সবাই এসে দাঁড়িয়ে রইলাম এলাকার দোকানে।
আমাদের মতো রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী! রিকশা-সিএনজিকে একশো টাকা দিয়েও গেইট পর্যন্ত যেতে রাজি করানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে দেখলাম ড্রেন থেকে সমস্ত তেলাপোকা উঠে গায়ে এসে বসছে! অনেক কষ্টে বলতে গেলে হাত-পা ধরে একটা রিকশাওয়ালাকে রাজি করিয়েছি, যেন সামনের গেইট দিয়ে অন্তত বাচ্চাগুলোকে বাসায় সেইফ ভাবে পৌঁছাতে পারি, ওই মুহূর্তে সবার একটাই চাওয়া ছিলো। তো সবার কথা মতো আমরা দুইজন উঠেছি। যেহেতু আমার এজমার সমস্যা, তাই সাথে আমাকে আর বাচ্চার নানীকে আগে বসতে বলা হলো। বাচ্চাগুলোকে কোলে নিয়েছি এবং একমনে দোয়াদুরূদ পড়ে কোমর সমান পানিতে রিকশায় বসেছি। ঠিক মাঝ বরাবর এসে পানির গভীরতা দেখে রিকশাওয়ালা বললো, সে কিছুতেই আর সামনে যাবে না! আমরা অনেক অনুরোধ করে বললাম, শুধু বাচ্চাগুলাকে বাঁচান! ওদের দিয়ে আসুন। সে বললো, একজন তাহলে নেমে যান। বাচ্চাদেরকে তার নানির কোলে তুলে দিয়ে আমি নেমে গেলাম। তখনো বুঝতে পারিনি, সামনে কী কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে আমার। কোমর সমান পানি দাবিয়ে আমাকে সেই দোকানে যেতে হবে বাঁচতে হলে! আমি কাঁদছি আর জুতোগুলো হাতে নিয়ে সামনে এগোচ্ছি। এক পা এগিয়ে গেলে পানির স্রোত দশ পা পিছনে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে পচা পানির গন্ধ, ময়লা, পোকামাকড় এবং সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত পানি ঠান্ডা! সমানে কাশি দিচ্ছি, বৃষ্টি চলছেই,আমি মনের জোরে পা ফেলে এই পানি পাড়ি দিয়ে সেই দোকানের সামনে চলে এলাম। সবাই আমাকে দেখে বকা দিচ্ছে, কেন তুমি চলে আসলা! কথা ছিলো, বাচ্চাগুলোকে বাসায় পাঠাতে পারলে আমরা বাকি সবাই পানি পাড়ি দিয়েই বাসায় যাবো।
আমরা কোমর সমান পানিতে ডুবতে ডুবতে গলা সমান পানিতে ভেসে চলছি! যে কোনো মুহূর্তে কারেন্ট শক খেয়ে কিংবা শ্বাসকষ্টে দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারি। এর মধ্যে ভয়, যদি পানির সাথে সাপ, পোকামাকড় ঢুকে পড়ে কি-না, সেই আতংকে আছি! যেতে যেতে দেখলাম, নীচতালাসহ পানি বন্দি বিপদগ্রস্ত মানুষের দরজায় দরজায়। পানিতে মানুষের ঘর ডুবে যাওয়ার ভেতর যে কি অসহায়ত্ব, যার ঘর ডুবলো, সে ছাড়া তা উপলব্ধি করা সম্ভব না ওই মুহূর্তে। গোটা এলাকার মানুষ পুরোটাই পানিবন্দি হয়ে আছে। বাসায় যেতে পারছে না। কী খাবে, তার খবর জানা নাই, পরে গ্যাস থাকবে না, খাবার পানি থাকবে না,ইলেক্ট্রিসিটি থাকবে না। জিনিসপত্রের দাম হাঁকবে আকাশের মতো বিশাল! এইসব ভাবছি আর পানি পার হচ্ছি! ভাবেন তো একবার! এসময় মনের ভেতর কী তীব্র রকমের অসহায়ত্ব চলে। কোনোমতে পিছনের গেইট পর্যন্ত কীভাবে যেন আসলাম! এসে কলিং বেল দিচ্ছি, দারোয়ানকে ডাকছি। সে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার বলেই যাচ্ছে, সামনের মেইন গেইট দিয়ে আসতে হবে! টাইলস বসিয়েছে, এইখান দিয়ে প্রবেশ করা যাবে না! নিষেধাজ্ঞা জারি আছে!
মানুষ কী পরিমাণ নিকৃষ্ট হলে টাইলস বাঁচানো জরুরি হয়ে পড়ে মানুষের প্রাণ না বাঁচিয়ে! তাও যদি নিজের এপার্টমেন্ট না হয়ে ভাড়াবাসা হতো, মানা যেত! নিজেদের বাসায় দারোয়ান ঢুকতে দিচ্ছে না! কারণ, দুই সিঁড়িতে টাইলস বসানো! ইচ্ছে করছিলো গেইট টপকে গিয়ে আমি ওরে কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিই। তার মধ্যে আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা, সাথে নেই ইনহেলার! পানিতে থাকতে থাকতে আমার অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ছে। আমি মনে মনে আল্লাহ্কে বলছি, হে আল্লাহ্, এমন করুণ মৃত্যু দিও না আমাকে। এই মুহূর্তে মরলে আমাকে কোথাও মাটি দিতে পারবে না, পানিতে ভাসিয়ে দেবে আমার লাশ! আমি এইভাবে মরতে চাই না। মাথার উপর বৃষ্টি, পায়ের নিচে কোমর সমান পানি! এইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম বিশ-পঁচিশ মিনিটের মতো! কত কষ্ট করার পরে রাত বারোটায় বাসায় ঢুকতে পেরেছিলাম, সেটা মনে করতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ছে।
মিডিয়া কাভারেজ হবে। দুই কেজি চাল, হাফ লিটার তেল, এক প্যাকেট লবণ, এক কেজি আলু আর হাফ কেজি মশুর ডাল নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে সরকার। তারপর আর কোন খবর থাকবে না। যাদের জমানো টাকা আছে, তারা লাগামহীন মূল্যে বিক্রি হওয়া দ্রব্য হয়তো কিনে খেতে পারবে। যাদের সঞ্চয় নাই, সমস্যা মূলত তাদের। অর্ধেক ঘরভর্তি জলের উপর ভেসে ভেসে অর্ধেক ডুবে যাওয়া খোলা দরজা দিয়ে মানুষের তাকিয়ে থাকা- এই বুঝি একটা নৌকা এসে কিছু সহায়তা দিয়ে যাবে।
সে যাই হোক, এদিকে আমি ঘরে বসে বসে একসাথে জ্বলে ওঠা পদ্মাসেতুর সব বাতির দিকে তাকিয়ে ভাবি- কী আর হবে দু- চারটা ঘর ডুবলে? দু-চারজন মানুষ অনাহারে মরলে? দু-চারমাস না খেলে, কী আর এমন হয়? বন্যায় গরীব মরে। মানুষ তো আর মরে না। মানুষের শুধু ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ড্রেন পরিষ্কার করলেও বাঙালি জাতির কোনো মাথাব্যথা নেই দেশ ক্লিন রাখার। আমরা বৃষ্টিতে তলিয়ে যাবো, দুইদিন ভুগবো, সরকারকে উনন্নয়ন করতে না পারার জন্য দুইটা গালি দেবো। দুইদিন পরে ফেসবুকে শেয়ার দেবো, স্লোগান দেবো,মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য। এখনই সময় মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর। ব্যাস, আমাদের দায়িত্ব শেষ।
আমি জীবনে অনেকবার বৃষ্টির ভিডিও করেছি, ছবি তুলেছি, কিন্তু কোনোদিন এমন পরিস্তিতির সম্মুখীন হইনি! আজকে সেই সব মুহূর্তের কথা চিন্তা করে খুব লজ্জা লাগছে। আজ বুঝতে পারছি, বৃষ্টি সব সময় আনন্দ দেয় না! এইটা আমার জন্য একটা ট্রাজেডি! আমি অনেক কিছু শিখেছি। এই একটা দিনের জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। এখন শুধু মনে হচ্ছে, বন্যা কবলিত নিচুতলার মানুষকে উচু যায়গায় রাখার জন্য কত সাহায্যের প্রয়োজন। যত বেশি সাহায্য করবে, ততো বেশি মানুষকে একটা সেইফ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে। মনে মনে আল্লাহ্কে বললাম, হে আমার রব! এই কঠিন পরিস্থিতিতে বন্যা কবলিত মানুষের হাহাকার আপনি শুনুন। বিপদে তাদের সাহায্য করুন। এই সমাজে কত বিত্তবান মানুষজন আছেন আমাদের আশে পাশে, তাদের একটু মানবিক হয়ে এগিয়ে আসতে সাহায্য করুন। মানুষের প্রতি সহায় হোন।
উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি চলছে। বিপৎসীমার উপর দিয়েই চলেছে নদীর পানি। বার সংকটে ভুগছে উত্তাঞ্চলের মানুষজন। পানিবন্দি মানুষ খুবই অসহায়। কেউ করে ক্ষুধার কষ্ট, কেউ করে বসবাসের কষ্ট, কেউ করে যাতায়াতের কষ্ট। তারাই ভালো জানে, যারা আমাদের মত ভুক্তভোগী। অন্যদিকে আবার নদী ভাঙন, তিস্তার বাঁধ ভাঙা পানি তো আছেই। নদীতে বাঁধ না দিলে গ্রামও থাকবে না, ভেঙে যাবে নদীতে সব কিছুই। তাই সরকারের উচিত ত্রাণের পাশাপাশি তাড়াতাড়ি পানি কমার সাথে সাথে নদীর ভাঙন ঠেকানোর ব্যবস্থা নেয়া। । না হয় পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে।
এখন ঘুমের ঘোরেও মনে হয় আমি পানিবন্দি! আল্লাহ্ সকল বন্যার্তদের এই খারাপ পরিস্থিতিতে যেন সহায় থাকেন।
[আফরিন ইনায়া, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়]