ছবি: সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক: সড়কের ওপরে দাঁড়ানো ভ্যানে নিথর দেহের স্তূপ। কয়েকটি লাশ ঢেকে দেয়া হয়েছে জীর্ণ চাদর দিয়ে। লাশের স্তূপের উপর লাশ তুলে রাখছেন মাথায় হেলমেট ও ভেস্ট পরা পুলিশ সদস্যরা। সেগুলো ঢাকার চেষ্টা করা হয় রাস্তার পাশে থাকা পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে। কিন্তু তা ভেদ করে বেরিয়ে আসে দেহগুলোর ঝুলে পড়া সারি সারি হাত।
এমনই লোমহর্ষক একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনায়।
কোথায় ঘটল এমন নিষ্ঠুর ঘটনা? ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার বলেছে, গণহত্যার পর ভ্যানে তোলা লাশের স্তূপের ঘটনাটি আশুলিয়া থানা এলাকার।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর ঐদিন বিকালে ঘটে এমন লোমহর্ষক ঘটনা। এসব লাশ একটি ভ্যানে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
গোপনে ধারণ করা ওই ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, গণহত্যার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মুছে ফেলতেই রহস্যজনকভাবে রাতারাতি থানার পাশের ও সামনের দেয়ালের রং মুছে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসিন্দার দাবি, ভিডিওতে দেয়ালে থাকা পোস্টারে যাকে দেখা গেছে, তিনি আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী আবুল হোসেন ভূঁইয়া। তবে পরে গণহত্যার বীভৎস সেই চিত্র মুছে ফেলার অপচেষ্টায় পোস্টারটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, ৫ আগস্টের পরপরই সব দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে।
এদিকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্বিচার গুলিতে গণহত্যার পর ভ্যানে তোলা কয়েকটি মরদেহের স্তূপের পাশে পুলিশকে হাঁটাহাঁটি করতেও দেখা গেছে। তাদের একজনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনিসহ ভিডিওচিত্রে থাকা পুলিশ সদস্যরা।
ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ছবিটি আরাফাতের বলে নিশ্চিত করেন। তার গ্ৰামের বাড়ি বরিশালে। প্রায় দুবছর আগে তিনি ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন।
ডিবি কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, ‘এ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আরাফাত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এখন উপরে আল্লাহ নিচে আপনারা। সেদিন আমরা কোনো গুলি করিনি। অলিগলিতে হাজারো ছাত্র-জনতা আমাদের ঘিরে ফেলেছিল। তবে আমরা গুলি করিনি।’
সেদিন কার নির্দেশে ডিবির টিম আশুলিয়ায় দায়িত্বে ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, ‘ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহিল কাফী স্যারের নির্দেশে সেদিন আমরা আশুলিয়ায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে ৫ আগস্ট আমরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলাম। নইলে আমাদেরকেও মরতে হতো।’
জানা যায়, ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবং তার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার খবরে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানা অভিমুখে অগ্রসর হলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে। এতে অনেকে নিহত হন। পরে সেই লাশগুলো একটি ভ্যানে তোলা হয়। সেখান থেকে একটি পিকআপে স্থানান্তর করার পরে গণহত্যার চিত্র মুছে ফেলতে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
পুড়িয়ে দেয়া হতভাগ্যদের মধ্যে ছিল সাভারের আশুলিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়া স্কুলছাত্র আস-সাবুর (১৬)। সে আশুলিয়ার জামগড়া শিমুলতলা এলাকার বাসিন্দা এনাফ নায়েদের ছেলে। আস-সাবুর স্থানীয় শাহীন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানায় গণহত্যার দিনে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের টিমের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
ভিডিওচিত্রে থাকা ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার সরকারি মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহত স্কুলছাত্র আস-সাবুরের সঙ্গে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সাহিদ হাসান ওরফে মিঠু সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম, তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদসহ আওয়ামী লীগের ১১৯ নেতাকর্মীকে আসামি করে সবার আগে আশুলিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পুলিশের একটি মহল গণহত্যার এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে সাহিদ হাসান ওরফে মিঠুকে বাদী করিয়ে মামলাটি দায়ের করে এমন অভিযোগ এনে কিশোর আস-সাবুরের মা রাহেন জান্নাত ফেরদৌসী নিজে বাদী হয়ে সন্তান হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেন।
সাংবাদিক সাব্বির আহমেদ জানান, এটা স্পষ্ট যে, পুলিশই গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপার দিতে সাহিদ হাসান ওরফে মিঠুকে ভাড়া করে মামলাটি দায়ের করায়।
জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়ায় গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৭৫ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে গেছেন সাড়ে ৪ শতাধিক মানুষ। যাদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন বলে জানা যায়।